ব্যাংকিং খাতে ঋণ ও আমানতে ভারসাম্য রক্ষায় সার্কুলার জারি করেছে বাংলাদেশ ব্যাংক। সার্কুলার অনুযায়ী বাণিজ্যিক ব্যাংকগুলো এখন ইচ্ছেমতো ঋণের...

ব্যাংকিং খাতে ঋণ ও আমানতে ভারসাম্য রক্ষায় সার্কুলার জারি করেছে বাংলাদেশ ব্যাংক। সার্কুলার অনুযায়ী বাণিজ্যিক ব্যাংকগুলো এখন ইচ্ছেমতো ঋণের সুদের হার বাড়াতে পারবে না। আবার আমানতের সুদহারও ইচ্ছেমতো কমাতে পারবে না। একই সঙ্গে জাল-জালিয়াতি রোধে ঋণের বিপরীতে জামানত হিসেবে ব্লাংক চেকও জমা নেওয়া যাবে না। কেন্দ্রীয় ব্যাংক থেকে এসব নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে।
সাম্প্রতিক সময়ে ব্যাংকগুলো আমানতের সুদহার মাত্রাতিরিক্ত কমানোয় আমানতের টাকা ব্যাংকের বাইরে ভিন্ন খাতে চলে যাওয়ার আশঙ্কা দেখা দিয়েছে। একই সঙ্গে ব্যাংকগুলো সুদহার যখনতখন বাড়ানো ও বিভিন্ন ধরনের চার্জ আরোপের ফলে ঋণের সুদহার বেড়ে যাচ্ছে। এতে ঋণগ্রহীতারা হয়রানির শিকার হচ্ছেন।
বাংলাদেশ ব্যাংক থেকে গতকাল একটি সার্কুলারে ঋণের বিপরীতে ইচ্ছেমতো সুদের হার বাড়ানো বা চার্জ আরোপের ব্যাপারে নিষেধাজ্ঞা আরোপ করে। এর সপ্তাহখানেক আগে অন্য এক সার্কুলারে কেন্দ্রীয় ব্যাংক থেকে বাণিজ্যিক ব্যাংকগুলোকে এই মর্মে নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে, তারা যাতে ইচ্ছেমতো আমানতের সুদের হার না কমায়।
বাংলাদেশ ব্যাংক থেকে গতকাল একটি সার্কুলারে ঋণের বিপরীতে ইচ্ছেমতো সুদের হার বাড়ানো বা চার্জ আরোপের ব্যাপারে নিষেধাজ্ঞা আরোপ করে। এর সপ্তাহখানেক আগে অন্য এক সার্কুলারে কেন্দ্রীয় ব্যাংক থেকে বাণিজ্যিক ব্যাংকগুলোকে এই মর্মে নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে, তারা যাতে ইচ্ছেমতো আমানতের সুদের হার না কমায়।
গতকাল জারি করা কেন্দ্রীয় ব্যাংকের সার্কুলারে বলা হয়, যেসব মেয়াদি ঋণের সুদহার পরিবর্তনশীল সেসব ক্ষেত্রে ব্যাংকগুলো গ্রাহককে না জানিয়ে সুদহার বাড়াতে পারবে না। সুদের হার বাড়ানোর কমপক্ষে এক মাস আগে গ্রাহককে জানাতে হবে।
উল্লেখ্য, একটি বেসরকারি ব্যাংকে ঋণের গড় সুদহার ১২ দশমিক ২ শতাংশ। অন্যদিকে আমানতের গড় সুদহার মাত্র ৩ দশমিক ৮১ শতাংশ।
কোনো গ্রাহক নির্ধারিত মেয়াদের আগে ঋণ পরিশোধ করে দিলে সেই ক্ষেত্রে ব্যাংকগুলো বাড়তি চার্জ আরোপ করে। এখন থেকে ব্যাংকগুলো এ ধরনের বাড়তি চার্জ আরোপ করতে পারবে না। তবে কোনো গ্রাহক নির্ধারিত সময়ের মধ্যে ঋণ শোধ করতে না পারলে বা দেরিতে শোধ করলে সেই ক্ষেত্রে গ্রাহকের বিষয়টি বিবেচনায় নিয়ে সর্বোচ্চ ২ শতাংশ হারে জরিমানা বা দ-সুদ আরোপ করা যাবে। এর বেশি হারে সুদ বা জরিমানা কোনো ক্রমেই আরোপ করা যাবে না।
সূত্র জানায়, গত কয়েক বছরে বেসরকারি খাতে বিনিয়োগ প্রবাহ কম থাকায় ব্যাংকগুলোয় ঋণের চাহিদা কমে গেছে। এ কারণে ব্যাংকে জমেছে মাত্রাতিরিক্ত অলস অর্থ। এসব অর্থের বিনিয়োগ বাড়াতে এবং আমানতের চাপ কমাতে ব্যাংকগুলো আমানত ও ঋণের সুদের হার কমাতে থাকে। গত দুই বছরে ব্যাংকগুলো ব্যাপক হারে আমানতের সুদের হার কমিয়েছে; কিন্তু সেই হারে ঋণের সুদের হার কমায়নি। ফলে ব্যাংকিং খাতে ঋণের চাহিদাও বাড়েনি। এ অবস্থায় ব্যাংকগুলোর আয় কমে যায়। আয় বাড়াতে ঋণের ওপর যখনতখন চার্জ আরোপ করছে, আবার সুদহার বাড়িয়ে দিচ্ছে। ফলে ঋণগ্রহীতাদের ওপর বাড়তি চাপ পড়ছে। এদিকে আমানতের সুদের হার মাত্রাতিরিক্ত কমানোয় গ্রাহকরা এখন ব্যাংকে আমানত রাখতে নিরুৎসাহিত হচ্ছেন। ফলে আমানতের একটি অংশ ভোগবিলাসে বা অন্য খাতে চলে যেতে পারে বলে আশঙ্কা করছে কেন্দ্রীয় ব্যাংক। তাদের আশঙ্কা এতে ঋণ ও আমানতের মধ্যে ভারসাম্য নষ্ট হতে পারে। এ বিষয়ে ব্যাংকগুলোকে সতর্ক করে দিয়ে গত সপ্তাহে অপর একটি সার্কুলার জারি করেছে।
ঋণ দেওয়ার সময় বেশকিছু শর্ত জুড়ে দেওয়া হয়। ওই শর্তের বেড়াজালে স্বল্পসুদের ঋণেও উচ্চ হারে সুদারোপ করছে ব্যাংকগুলো। এ বিষয়ে কেন্দ্রীয় ব্যাংকে অভিযোগ করে সুনির্দিষ্ট আইন না থাকায় কোনো সুফল পাচ্ছিল না গ্রাহক। এমনকি অতিরিক্ত সুদহার থেকে রেহাই পেতে কোনো কোনো গ্রাহক মেয়াদপূর্তির আগেই ঋণ পরিশোধের চেষ্টা করেন; কিন্তু তাতেও পুরো মেয়াদ হিসাব করে তার ওপর নির্দিষ্ট হারে সুদ আদায় করা হচ্ছে।
কেন্দ্রীয় ব্যাংকে পাঠানো এক গ্রাহকের অভিযোগে দেখা যায়, ওই গ্রাহক ১১ শতাংশ সুদে একটি বিদেশি ব্যাংকে ২০ বছর মেয়াদে ‘হোমলোন’ গ্রহণ করেন; কিন্তু অনেক শর্তের ভেতরে একটি শর্ত ছিল ২ বছর পর ব্যাংকটি সুদ পরিবর্তন করতে পারবে। ওই শর্তের ওপর ভিত্তি করে ২ বছর পরই ঋণের সুদ ২ শতাংশ বাড়িয়ে ১৩ শতাংশ করা হয়। পরে আরও দুবার সুদহার বাড়িয়ে ১৬ শতাংশ করা হয়। এর প্রতিকার চেয়ে কেন্দ্রীয় ব্যাংকে অভিযোগ করেন ওই গ্রাহক; কিন্তু আগে থেকেই শর্ত থাকায় এবং এ সংক্রান্ত কোনো আইন বা নির্দেশনা না থাকায় ব্যাংকটির বিরুদ্ধে কোনো ব্যবস্থা নিতে পারেনি কেন্দ্রীয় ব্যাংক। এখনো এ ধরনের অনেক অভিযোগ আসছে কেন্দ্রীয় ব্যাংকে।
কেন্দ্রীয় ব্যাংকে পাঠানো এক গ্রাহকের অভিযোগে দেখা যায়, ওই গ্রাহক ১১ শতাংশ সুদে একটি বিদেশি ব্যাংকে ২০ বছর মেয়াদে ‘হোমলোন’ গ্রহণ করেন; কিন্তু অনেক শর্তের ভেতরে একটি শর্ত ছিল ২ বছর পর ব্যাংকটি সুদ পরিবর্তন করতে পারবে। ওই শর্তের ওপর ভিত্তি করে ২ বছর পরই ঋণের সুদ ২ শতাংশ বাড়িয়ে ১৩ শতাংশ করা হয়। পরে আরও দুবার সুদহার বাড়িয়ে ১৬ শতাংশ করা হয়। এর প্রতিকার চেয়ে কেন্দ্রীয় ব্যাংকে অভিযোগ করেন ওই গ্রাহক; কিন্তু আগে থেকেই শর্ত থাকায় এবং এ সংক্রান্ত কোনো আইন বা নির্দেশনা না থাকায় ব্যাংকটির বিরুদ্ধে কোনো ব্যবস্থা নিতে পারেনি কেন্দ্রীয় ব্যাংক। এখনো এ ধরনের অনেক অভিযোগ আসছে কেন্দ্রীয় ব্যাংকে।
এ ছাড়া ব্যাংক থেকে ঋণ গ্রহণের ক্ষেত্রে গ্রাহকের স্বাক্ষর সংবলিত ৫ থেকে ৬টি ব্লাঙ্ক চেক গ্রহণ করে ব্যাংক। ওই চেক নিয়ে ব্যাংকের কর্মকর্তারা টাকা আত্মসাৎ করেছেন বলেও কেন্দ্রীয় ব্যাংকে লিখিত অভিযোগ রয়েছে। তা ছাড়া কোনো কারণে গ্রাহক টাকা ফেরত দিতে ব্যর্থ হলে বা গ্রাহকের সঙ্গে ব্যাংকের সম্পর্ক খারাপ হলেও জামানত হিসেবে গ্রহণ করা চেক দিয়ে আদালতে মামলা করে ব্যাংক। এক্ষেত্রে গ্রাহকের অ্যাকাউন্টে পর্যাপ্ত টাকা না থাকায় চেক ফেরত আসায় (ডিজঅনার) প্রতারণা মামলা করা হয়।
বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক গভর্নর ড. সালেহউদ্দিন আহমেদ বলেন, সুদকে সব সময় বাজারভিত্তিক রাখার জন্য সুদ পরিবর্তনের শর্ত থাকে; কিন্তু আমাদের দেশে ব্যাংক কখনো সুদ কমায়নি। সব সময় বাড়ায়। এটি হয়েছে কারণ ব্যাংকিং খাতে প্রতিযোগিতা সৃষ্টি হয়নি। এক ধরনের মনোপলির মধ্যে গ্রাহকরা পড়ে গেছেন। এতে ক্ষুদ্র ও মাঝারি ঋণগ্রহীতারা বেশি বিপাকে। সুদ থেকে রেহাই পেতে গ্রাহক আগেই ঋণ পরিশোধ করতে চাইলে সেক্ষেত্রে আর্লি সেটেলমেন্ট ফি আদায় করছে। এগুলো বন্ধ করতে কেন্দ্রীয় ব্যাংকে আরও নজরদারি বাড়াতে হবে। কোনো ঋণের ক্ষেত্রে অহেতুক সুদহার বাড়ানো হচ্ছে কিনা তা দেখার উদ্যোগ নিতে হবে।
ব্যাংকগুলোর প্রধান নির্বাহীদের সংগঠন অ্যাসোসিয়েশন অব ব্যাংকার্স বাংলাদেশের (এবিবি) সভাপতি ও মিউচ্যুয়াল ট্রাস্ট ব্যাংকের এমডি আনিস এ খান বলেন, চেক গ্রহণ করা ঋণের বিপরীতে এক ধরনের সিকিউরিটি। যথাসময়ে ঋণ ফেরত না দিলেও ওই সিকিউরিটি ব্যবহার করেই আদালতে মামলা করা হয়। তবে কেন্দ্রীয় ব্যাংক সার্কুলারে কী ধরনের নির্দেশ দিয়েছে তা আমার জানা নেই। সার্কুলার না দেখে এ বিষয়ে কোনো মন্তব্য করা ঠিক হবে না।
ব্যাংকগুলোর প্রধান নির্বাহীদের সংগঠন অ্যাসোসিয়েশন অব ব্যাংকার্স বাংলাদেশের (এবিবি) সভাপতি ও মিউচ্যুয়াল ট্রাস্ট ব্যাংকের এমডি আনিস এ খান বলেন, চেক গ্রহণ করা ঋণের বিপরীতে এক ধরনের সিকিউরিটি। যথাসময়ে ঋণ ফেরত না দিলেও ওই সিকিউরিটি ব্যবহার করেই আদালতে মামলা করা হয়। তবে কেন্দ্রীয় ব্যাংক সার্কুলারে কী ধরনের নির্দেশ দিয়েছে তা আমার জানা নেই। সার্কুলার না দেখে এ বিষয়ে কোনো মন্তব্য করা ঠিক হবে না।
গতকাল জারি করা সার্কুলারে বলা হয়, যেসব মেয়াদি ঋণের সুদহার (ইসলামী ব্যাংকের পরিভাষায় বিনিয়োগের ওপর মুনাফার হার) পরিবর্তনশীল, সেক্ষেত্রে সুদ বা মুনাফার হার বৃদ্ধি করতে হলে তার যৌক্তিকতা তুলে ধরে গ্রাহককে এক মাস সময় দিয়ে নোটিশ প্রদান করতে হবে। নোটিশের সঙ্গে গ্রাহককে হালনাগাদ দায়সহ নতুন পরিশোধসূচি সরবরাহ করতে হবে এবং গ্রাহককে ই-মেইল অথবা চিঠি দ্বারা নোটিশ দিতে হবে। মঞ্জুরিপত্রের শর্তাবলিতেও এ বিষয়টি অন্তর্ভুক্ত করতে হবে। সুদ বা মুনাফার হার বৃদ্ধির কারণে গ্রাহক যদি এক মাসের মধ্যে ঋণ বা বিনিয়োগের অর্থ পরিশোধ করতে চান তবে ‘আর্লি সেটেলমেন্ট ফি’ বা অতিরিক্ত কোনো ফি আদায় ব্যতীত পরিশোধের সুযোগ পাবেন।
সূত্র জানায়, ব্যাংক থেকে ঋণ নেওয়ার ক্ষেত্রে বিভিন্ন খাত দেখিয়ে সার্ভিস চার্জ আদায় করে ব্যাংক। এতে ঋণের সুদহার আরও ২ থেকে ৪ শতাংশ বেড়ে যায়। ঋণ নিয়ে তা ফেরত দিতে গেলেও সুদ পরিশোধ করতে হয় গ্রাহককে। কোনো গ্রাহক চলতি ঋণ হিসেবে যদি ১০ লাখ টাকা গ্রহণ করেন, দুই মাসে সুদসহ ৪ লাখ পরিশোধ করার পর বাকি ৬ লাখ টাকাও পরিশোধ করতে চান, তাহলে তাকে ওই টাকার বিপরীতেও সুদ পরিশোধ করতে হবে। চলতি ঋণের মেয়াদ সাধারণত এক বছর। চলতি ঋণ বা ডিমান্ড লোনের বিপরীতে এক্ষেত্রে ২ থেকে আড়াই শতাংশ হারে ফি আদায় করে ব্যাংক। গতকালের সার্কুলারে বলা হয়, চলতি ঋণ বা ডিমান্ড লোনের (ইসলামী ব্যাংকের পরিভাষায় এরূপ বিনিয়োগ) ক্ষেত্রে কোনো ‘আর্লি সেটেলমেন্ট ফি’ আরোপ করা যাবে না।
সার্কুলারে আরও বলা হয়, মেয়াদি ঋণের (ইসলামী ব্যাংকের ক্ষেত্রে অনুরূপ বিনিয়োগের) কিস্তি পরিশোধে বিলম্বের জন্য বিলম্ব ফি/দণ্ডসুদ/ক্ষতিপূরণ আদায়ের ক্ষেত্রে যেসব গ্রাহক প্রকৃতই অসুবিধায় আছেন, তাদের বিষয়টি বিবেচনায় নিয়ে স্বীয় নীতিমালার আলোকে তা নিষ্পত্তি করতে হবে। কোনোভাবেই এ ধরনের বিলম্ব ফি, দণ্ডসুদ বা ক্ষতিপূরণ ওই ঋণ বা বিনিয়োগের জন্য প্রযোজ্য সুদ বা মুনাফার হার +২ শতাংশের অধিক হবে না। এছাড়া সম্প্রতি এমআইসিআর চেকের ক্ষেত্রে প্রতারণা ও জাল-জালিয়াতি বৃদ্ধি পাওয়ায় ঋণ বা বিনিয়োগের বিপরীতে ব্লাঙ্ক চেক জামানত হিসেবে গ্রহণ না করার জন্যও পরামর্শ দেওয়া যাচ্ছে।