দেশের ব্যাংকিং খাতে ঋণ কেন্দ্রীভূত রয়েছে নির্দিষ্ট কিছু গ্রাহকের কাছে। অন্তর্ভুক্তিমূলক উন্নয়নের জন্য ব্যাংকিং খাত থেকে সারা দেশে ...
দেশের ব্যাংকিং খাতে ঋণ কেন্দ্রীভূত রয়েছে নির্দিষ্ট কিছু গ্রাহকের কাছে। অন্তর্ভুক্তিমূলক উন্নয়নের জন্য ব্যাংকিং খাত থেকে সারা দেশে ঋণ ছড়িয়ে দেয়ার জন্য দীর্ঘদিন ধরে দাবি জানিয়ে আসছেন বিশেষজ্ঞরা। বাংলাদেশ ব্যাংকও বিভিন্ন সময়ে উদ্যোক্তা তৈরির জন্য ছোট ছোট ঋণ বিতরণের জন্য ব্যাংকগুলোকে নির্দেশনা দিয়ে আসছে। এর পরও সম্প্রসারণ ঘটছে না ব্যাংকঋণের। বরং দিন দিন শীর্ষ গ্রাহকদের হাতেই আরো কেন্দ্রীভূত হয়ে উঠছে এ ঋণ। এ অবস্থা এখন এমন এক পর্যায়ে পৌঁছেছে যে, দেশের শীর্ষ তিন গ্রাহক খেলাপি হলে মূলধন সক্ষমতা হারাবে ২৫টি ব্যাংক। এ চিত্র উঠে এসেছে বাংলাদেশ ব্যাংকের গত বছরের সেপ্টেম্বর প্রান্তিকের ফিন্যান্সিয়াল স্ট্যাবিলিটি অ্যাসেসমেন্ট বা আর্থিক স্থিতিশীলতা প্রতিবেদনে।
দেশের ৫৬টি ব্যাংক থেকে পাওয়া ২০১৬ সালের সেপ্টেম্বর পর্যন্ত হালনাগাদ তথ্যের ভিত্তিতে প্রতিবেদনটি তৈরি করেছে বাংলাদেশ ব্যাংকের ফিন্যান্সিয়াল স্ট্যাবিলিটি বিভাগ। প্রতি তিন মাস পর পর দেশের ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলোর স্থায়িত্বের পরিমাপ করে এ প্রতিবেদন প্রকাশ করা হয়।
প্রতিবেদনের তথ্যমতে, দেশের ব্যাংকগুলোর প্রতিটির শীর্ষ তিনজন গ্রাহক খেলাপি হলে ক্যাপিটাল টু রিস্ক (ওয়েটেড) অ্যাসেটস রেশিও (ঝুঁকিভারিত সম্পদের বিপরীতে মূলধন— সিআরএআর) সংরক্ষণে ব্যর্থ হবে ২৫টি ব্যাংক। শীর্ষ সাত গ্রাহক খেলাপি হলে সিআরএআর সংরক্ষণে ব্যর্থ হবে ৩৩টি ব্যাংক। অন্যদিকে শীর্ষ ১০ গ্রাহক খেলাপি হলে এ ঝুঁকিতে পড়ে যায় ৩৭টি ব্যাংক। সব মিলিয়ে শীর্ষ গ্রাহকরা খেলাপি হলে ঝুঁকিযুক্ত সম্পদের বিপরীতে মূলধন সক্ষমতা হারাবে দেশের অর্ধেকের বেশি ব্যাংক।
কেন্দ্রীয় ব্যাংকের নির্দেশনা সত্ত্বেও ঋণের বিকেন্দ্রীকরণে ব্যর্থ হচ্ছে ব্যাংকগুলো। বরং দিন দিন শীর্ষ গ্রাহকদের দিকে আরো কেন্দ্রীভূত হয়ে উঠেছে ব্যাংকগুলোর ঋণ। ২০১৫ সালের ডিসেম্বর শেষেও শীর্ষ তিন গ্রাহক খেলাপি হলে সিআরএআর সংরক্ষণের ব্যর্থতার ঝুঁকিতে ছিল ২১টি ব্যাংক। শীর্ষ সাত ও ১০ গ্রাহক খেলাপি হওয়ার ক্ষেত্রে সিআরএআর সংরক্ষণে ব্যর্থ হতো যথাক্রমে ৩২ ও ৩৫টি ব্যাংক। সে হিসাবে গত বছর দেশের ব্যাংকগুলো শীর্ষ গ্রাহকদের ওপর আরো বেশি পরিমাণে নির্ভরশীল হয়ে পড়েছে।
এ প্রসঙ্গে বাংলাদেশ ইনস্টিটিউট অব ব্যাংক ম্যানেজমেন্টের (বিআইবিএম) পরিচালক অধ্যাপক ড. প্রশান্ত কুমার ব্যানার্জি বলেন, বড় গ্রাহকরা ব্যাংক থেকে ঋণ পাচ্ছে, এতে সমস্যার কিছু নেই। তবে দেশের অন্তর্ভুক্তিমূলক উন্নয়নের জন্য এসএমই ও ক্ষুদ্র ঋণ বিতরণ বাড়াতে হবে। ব্যাংকগুলোকে বেশি বেশি উদ্যোক্তা তৈরির দিকে নজর দিতে হবে। অল্প কিছু গ্রাহককে বড় অংকের ঋণ দেয়া ব্যাংকগুলোর জন্য শুভকর নয়।
বাংলাদেশ ব্যাংকের প্রতিবেদনে ব্যাংকগুলোর সংকটকালীন সহনক্ষমতা পরীক্ষায় ঋণঝুঁকি, বাজারঝুঁকি ও তারল্যঝুঁকি— এ তিন ধরনের ঝুঁকি পরীক্ষার তথ্য তুলে ধরা হয়েছে। এতে বলা হয়, খেলাপি ঋণ ৩ শতাংশ বাড়লে সিআরএআর সংরক্ষণে ব্যর্থ হবে ছয়টি ব্যাংক। ২০১৫ সালের ডিসেম্বরে এ ঝুঁকিতে ছিল সাতটি ব্যাংক।
এছাড়া খেলাপি ঋণ ৯ শতাংশ বাড়লে ২৯টি ও ১৫ শতাংশ বাড়লে ৩৩টি ব্যাংক সিআরএআর সংরক্ষণে ব্যর্থ হবে। ২০১৫ সালের ডিসেম্বরে এ ঝুঁকির তালিকায় ছিল যথাক্রমে ১৯ ও ৩২টি ব্যাংক।
এছাড়া খেলাপি ঋণ ৯ শতাংশ বাড়লে ২৯টি ও ১৫ শতাংশ বাড়লে ৩৩টি ব্যাংক সিআরএআর সংরক্ষণে ব্যর্থ হবে। ২০১৫ সালের ডিসেম্বরে এ ঝুঁকির তালিকায় ছিল যথাক্রমে ১৯ ও ৩২টি ব্যাংক।
ব্যাংক খাতের সার্বিক অবস্থা যাচাইয়ে প্রতিবেদনে বাজারঝুঁকির বিষয়ে বলা হয়েছে, সুদের হার ১ শতাংশ কমালে প্রয়োজনীয় মূলধন সংরক্ষণে ব্যর্থ হবে চারটি ব্যাংক। ২০১৫ সালের ডিসেম্বরে এ ঝুঁকিতে ছিল তিনটি ব্যাংক। ঋণের সুদহার ২ ও ৩ শতাংশ কমলে সিআরএআর সংরক্ষণে ব্যর্থ হবে যথাক্রমে নয় ও ১০টি ব্যাংক। আর ব্যাংক খাতে ইকুইটির মূল্য ১০, ২০ ও ৪০ শতাংশ কমলে মূলধন সংরক্ষণে ব্যর্থ হবে তিন-চারটি ব্যাংক।
এছাড়া ঋণের বিপরীতে ঋণগ্রহীতাদের জামানত রাখা সম্পদের মূল্য ১০ শতাংশ কমলে সিআরএআর সংরক্ষণে ব্যর্থতার ঝুঁকিতে রয়েছে দুটি ব্যাংক। একইভাবে ২০ ও ৪০ শতাংশ হারে জামানতের সম্পদমূল্য কমলে যথাক্রমে এ ঝুঁকিতে পড়ে যায় যথাক্রমে তিন ও আটটি ব্যাংক।
ব্যাংক হিসাবে খেলাপি ঋণের ক্ষেত্রে নিম্নমান, সন্দেহজনক ও মন্দঋণ— এ তিনটি ধাপ রয়েছে। বাংলাদেশ ব্যাংকের স্ট্রেস টেস্টিংয়ে বলা হচ্ছে, খেলাপি ঋণের ধাপ ৫ শতাংশ অবনমন হলে ঝুঁকিযুক্ত সম্পদের বিপরীতে মূলধন সংরক্ষণে ব্যর্থ হবে দুটি ব্যাংক। একইভাবে ১০ ও ১৫ শতাংশ অবনমনে সিআরএআর সংরক্ষণে ব্যর্থ ব্যাংকের সংখ্যা দাঁড়াবে যথাক্রমে ১৫ ও ২২টিতে। বর্তমানে ব্যাংকিং খাতের খেলাপি ঋণের প্রায় ৮২ দশমিক ৪ শতাংশের বেশি মন্দঋণে পরিণত হয়েছে, যা আদায়ের সম্ভাবনা খুবই কম।
এ প্রসঙ্গে বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক গভর্নর ড. সালেহউদ্দিন আহমেদ বলেন, খেলাপি ঋণ দেশের ব্যাংকিং খাতের জন্য বোঝা হয়ে দাঁড়িয়েছে। মূলধন ঝুঁকিতে থাকা অধিকাংশ ব্যাংকই সরকারি খাতের। প্রায় ২০ শতাংশ ঋণ খেলাপি রেখে এ ব্যাংকগুলো ঋণের সুদহার কমাতে পারবে না। বড় অংকের ঋণ খেলাপি হওয়ার কারণে মূলধন সংকটের ঝুঁকি সৃষ্টি হয়েছে। যেসব ব্যাংকের খেলাপি ঋণের পরিমাণ বেশি, সেগুলোর মূলধন সংকটের ঝুঁকিও বেশি। ব্যাংকগুলো আমানতের সুদহার প্রত্যাশার চেয়েও কমিয়ে দিচ্ছে। এতে করে সামগ্রিকভাবে সাধারণ আমানতকারী ও গ্রাহক চরমভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে।
বাংলাদেশ ব্যাংকের পরিসংখ্যান অনুযায়ী, ২০১৫ সালের ডিসেম্বর শেষে ব্যাংকিং খাতের খেলাপি ঋণ ছিল ৫১ হাজার ৩৭১ কোটি টাকা। ২০১৬ সালের সেপ্টেম্বর শেষে এ খেলাপি ঋণের পরিমাণ ৬৫ হাজার ৩৬৫ কোটি টাকায় দাঁড়িয়েছে। একই সময়ে ব্যাংকগুলো অবলোপন করেছে ৪২ হাজার ৬৭৪ কোটি টাকার ঋণ। সব মিলিয়ে গত বছরের সেপ্টেম্বর শেষে বাংলাদেশ ব্যাংকের তফসিলভুক্ত ৫৬টি ব্যাংকের খেলাপি ঋণের পরিমাণ দাঁড়িয়েছে ১ লাখ ৮ হাজার ৩৯ কোটি টাকায়। সেপ্টেম্বর শেষে ব্যাংকিং খাতের মোট বিতরণকৃত ঋণের ১০ দশমিক ৩৪ শতাংশই গেছে খেলাপির খাতায়। অবলোপনকৃত ঋণ যোগ করলে এ হার ১৫ শতাংশ ছাড়িয়ে যায়। এ বিপুল পরিমাণ খেলাপি ঋণের ৪৭ দশমিক ৭ শতাংশই মাত্র পাঁচটি ব্যাংকের। আবার মোট খেলাপি ঋণের ৬৪ দশমিক ৮ শতাংশের ভার চেপে রয়েছে ১০ ব্যাংকের ওপর।
গত বছরের সেপ্টেম্বর শেষে রাষ্ট্রায়ত্ত সোনালী ব্যাংকের খেলাপি ঋণের পরিমাণ দাঁড়ায় ৮ হাজার ৫৬১ কোটি টাকায়। এছাড়া এ সময় জনতা ব্যাংকের ৬ হাজার ৭৯৪ কোটি, অগ্রণী ব্যাংকের ৫ হাজার ৭১১ কোটি, বেসিক ব্যাংকের ৪ হাজার ৯৮৫ কোটি ও বাংলাদেশ কৃষি ব্যাংকের ৪ হাজার ৮৪১ কোটি টাকার ঋণ খেলাপি হয়েছে। সব মিলিয়ে এ পাঁচ ব্যাংকের মোট খেলাপি ঋণের পরিমাণ ৩০ হাজার ৮৯৩ কোটি টাকা।
এ বিষয়ে অগ্রণী ব্যাংকের চেয়ারম্যান ড. জায়েদ বখত বলেন, বড় ঋণগুলো পুনঃতফসিলের মাধ্যমে খেলাপি ঋণ কমিয়ে আনার উদ্যোগ নেয়া হয়েছিল। রাজনৈতিক অস্থিতিশীলতার কারণে ব্যবসা খারাপ হওয়ার দোহাই দিয়ে বড় বড় গ্রাহকরা এ সুযোগ নেয়। কিন্তু পরবর্তীতে সুযোগ নিয়েও তারা ঋণখেলাপি হয়ে গেছে। রাজনৈতিক ক্ষমতার সুযোগ নিয়েই তারা এমনটি করছেন। বাংলাদেশ ব্যাংক ও অর্থ মন্ত্রণালয় কঠোর হলে ব্যাংকিং খাতে খেলাপি ঋণের পরিমাণ কমে আসত। কারণ ব্যাংক নিজ ক্ষমতাবলে তিনবারের বেশি কোনো ঋণ পুনঃতফসিল করতে পারে না। এক্ষেত্রে প্রভাবশালীরা ব্যাংকের ওপর চাপ দিয়ে বাংলাদেশ ব্যাংকে চতুর্থ বা পঞ্চমবারের মতো ঋণ পুনঃতফসিলের জন্য আবেদন করাচ্ছেন। কিছু টাকা দিয়ে ঋণ পুনঃতফসিল করা হলেও কিছুদিন পরই তারা আবার খেলাপি হয়ে যাচ্ছেন।
সার্বিক বিষয়ে বাংলাদেশ ব্যাংকের নির্বাহী পরিচালক ও মুখপাত্র শুভঙ্কর সাহা বলেন, দেশের ব্যাংকিং খাতের ঝুঁকি ও চাপ নেয়ার সক্ষমতা যাচাই করার জন্য কেন্দ্রীয় ব্যাংক ত্রৈমাসিক ভিত্তিতে আর্থিক স্থিতিশীলতা প্রতিবেদন তৈরি করে। সাম্প্রতিক প্রতিবেদনে ব্যাংকিং খাতের সামগ্রিক চিত্র উঠে এসেছে। কিছু কিছু সূচকে দেশের ব্যাংকিং খাত উন্নতি করেছে। সমস্যাগুলো চিহ্নিত করে সমাধানের জন্য ব্যাংকগুলোকে নিয়মিতভাবে দিকনির্দেশনা দেয়া হচ্ছে। ব্যাংকিং খাতের ঝুঁকি কমানোর জন্য ঋণের বিকেন্দ্রীকরণের ওপর জোর দেয়া হচ্ছে। সূত্রঃ বণিক বার্তা