চুয়াডাঙ্গার কৃতি সন্তান অধ্যক্ষ হামিদুল হক মুন্সী মাতৃভাষা সাহিত্য পদকে ভূষিত হয়েছেন। সিরাজগঞ্জের উল্লাপাড়া মাল্টিমিডিয়া অডিটরিয়ামে ...
চুয়াডাঙ্গার কৃতি সন্তান অধ্যক্ষ হামিদুল হক মুন্সী মাতৃভাষা সাহিত্য পদকে ভূষিত হয়েছেন।
সিরাজগঞ্জের উল্লাপাড়া মাল্টিমিডিয়া অডিটরিয়ামে সম্প্রতি আনুষ্ঠানিকভাবে পদক প্রদান করা হয়।
রাজশাহীর নর্থ বেঙ্গল ইন্টারন্যাশনাল ইউনিভাসিটির উপউপাচার্য ড. মুহাম্মদ আব্দুল জলিল প্রধান অতিথি হিসেবে উপস্থিত থেকে হামিদুল হক মুন্সীর হাতে ক্রেস্ট, উত্তোরীয় এবং সনদ তুলে দেন।উল্লাপাড়া কবিতা পরিষদের সভাপতি মোঃ আবুবকর সিদ্দিকের সভাপতিত্বে অনুষ্ঠিত আলোচনাপর্বে ড. মোঃ আব্দুস সাত্তার, বীর মুক্তিযোদ্ধা গোলাম মোস্তফা, সৈয়দ আব্দুস শুকুর, স্বপন কুমার মন্ডল, এইচএম সহরাওয়াদীর্ , সাংবাদিক সাহেব আলী, ডা. মোহাঃ সাইফুল ইসলাম প্রমুখ আলোচনায় অংশ নেন।
অধ্যক্ষ হামিদুল হক মুন্সীর জন্ম চুয়াডাঙ্গা জেলায় আলমডাঙ্গা উপজেলার বাঁচামারী গ্রামে ১৯৫৭ সালের ১৬ মার্চ তিনি এক মুসলিম পরিবারে জন্মগ্রহণ করেন। তাঁর পিতা মরহুম হাজী লুৎফর হক মুন্সী, মাতা হামিদা খাতুন।
বাবা-মায়ের ছয় সন্তানের মধ্যে তিনি প্রথম। তাঁর শিক্ষা জীবন শুরু হয় আসমানখালী প্রাথমিক বিদ্যালয় থেকে। পরবর্তীতে নতিপোতা হাইস্কুল থেকে মাধ্যমিক পরীক্ষা পাস করে ভর্তি হন চুয়াডাঙ্গা কলেজে। এই কলেজ থেকে উচ্চ মাধ্যমিক পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হয়ে যশোর মাইকেল মধুসূদন কলেজে বাংলা ভাষা ও সাহিত্যে অনার্স বিষয়ে ভর্তি হন। এখান থেকে অনার্স পাস করে একই বিষয়ে মাষ্টার্সে ভর্তি হন রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে বাংলা বিভাগ থেকে থেকে উচ্চ শিক্ষা গ্রহণ করে তিনি কর্মজীবনে পদার্পণ করেন। ছাত্র জীবনেই তিনি প্রগতিশীল ভাবধারায় নিজের জীবন পরিচালিত করেন। সাংবাদিকতা ও লেখালেখির পাশাপাশি বিভিন্ন সাংস্কৃতিক কর্মকান্ডে জড়িয়ে পড়েন। তিনি ছাত্র রাজনীতির সঙ্গেও জড়িত ছিলেন। তখনকার তারুণ্যদীপ্ত অধিকাংশ ছাত্রছাত্রীর মতো তাঁরও পছন্দের সংগঠন ছিল ছাত্র ইউনিয়ন। তিনি কর্মজীবনে প্রবেশ করে রাজনীতির সঙ্গে সম্পর্ক ছিন্ন করেন। অক্লান্ত নিরলস কর্মী হামিদুল হক মুন্সীর কর্মজীবন শুরু হয় ১৯৮৩ সালে দর্শনা কলেজে অধ্যাপনার মাধ্যমে। একই বছর তিনি যোগদান করেন চুয়াডাঙ্গা পৌর কলেজের বাংলা বিভাগে। দীর্ঘদিন তিনি এই কলেজের ভারপ্রাপ্ত অধ্যক্ষ হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন। এরপর যোগদান করেন নড়াইল আব্দুল হাই ডিগ্রী কলেজের অধ্যক্ষ পদে। ১৯৯০ সাল থেকে ২০০২ সাল পর্যন্ত এক যুগ তিনি অত্যন্ত নিষ্ঠার সঙ্গে এই কলেজের অধ্যক্ষ হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন। এরপর ২০০২ সালের ১৫ সেপ্টেম্বর যোগদান করেন উল্লাপাড়া বিজ্ঞান কলেজে। সেখানে তিনি অত্যন্ত সততা, নিষ্ঠা ও আন্তরিকতার সাথে উল্লাপাড়া বিজ্ঞান কলেজে অধ্যক্ষ হিসেবে দায়িত্ব পালন করেছেন।
অধ্যক্ষ হামিদুল হক মুন্সী একজন চিন্তাশীল ও ভাবুক মানুষ। তাঁর চিন্তা-চেতনা ও ভাব-ভাবনাকে তিনি লেখনীর মাধ্যমে স্থায়ী রূপদান করেছেন। তাঁর চিন্তা এসেছে সমাজ বিশেষ করে শিক্ষা-সংস্কৃতির সম্পর্কে শুভবোধ থেকে। স্বদেশের ইতিহাস-ঐতিহ্য এবং মুক্তিযুদ্ধের গৌরবগাঁথা নিয়েও তিনি চিন্তাশীল মননের পরিচয় দিয়েছেন। এসব বিষয়ে লেখা তাঁর বইগুলো হলো “চুয়াডাঙ্গা জেলার ইতিহাস” “চুয়াডাঙ্গা ‘৭১, ‘একাত্তরের বিজয়গাঁথা” “আন্দোলন সংগ্রামে চুয়াডাঙ্গা” “চুয়াডাঙ্গা গেজেট” “মুক্তিযুদ্ধে চুয়াডাঙ্গা”, “চুয়াডাঙ্গা পরিচিতি”, “নড়াইল পরিচিতি” চুয়াডাঙ্গার গুণীজন”, “শিক্ষা প্রতিষ্ঠান প্রধানের দায়িত্ব ও কর্তব্য”, “শিক্ষা প্রতিষ্ঠান: ব্যবস্থাপনা ও পরিচালনা” এবং পরীক্ষায় বেশি নম্বর পাবার উপায়’”। তাঁর ভাবুক হৃদয়ের প্রকাশ ঘটেছে কাব্যগ্রন্থে। প্রেমের বহুমাত্রিক বিন্যাশে তাঁর কাব্যগুলো সমৃদ্ধ। পূর্বরাগ, অনুরাগ, মান-অভিমান, বিরহ এসব তাঁর কবি কবিতার মূলীভূত উপাদান। তার কাব্যগ্রন্থগুলো হল “বয়েসী রোদের বিউগল” “মাধবী শুধু তোমাকেই”, “অবরুদ্ধ নগরে আছি”, “লগ্নে মগ্ন যখন” “দেখা হলে বলতাম”, “প্রতিদ্বন্দ্বী এসো যুদ্ধ হবে”, “ভালোবাসা গেছে এই পথে” ও “মাটির জলে প্রাণের কবিতা’, ‘আমার মৃত্যু সংবাদ’, ‘আমার একটা কন্যা ছিল’, ‘মিথুন রাশির ফুল’। সাহিত্য রচনার পাশাপাশি সাংবাদিকতার ভূবনে ছিল তাঁর অবাধ বিচরণ। দীর্ঘদিন তিনি দৈনিক সংবাদের চুয়াডাঙ্গা প্রতিনিধি ছিলেন। “দৈনিক মাথাভাঙ্গা” পত্রিকার তিনি প্রতিষ্ঠাতা সম্পাদক। এছাড়া তিনি অর্ধ-শতাধিক সাময়িকী সম্পাদনা করেছেন। একজন দক্ষ সংগঠক হিসেবেও তিনি কৃতিত্বের স্বাক্ষর রেখেছেন। চুয়াডাঙ্গা ইতিহাস পরিষদ, চুয়াডাঙ্গা সাহিত্য পরিষদ, মুক্তবাণী সাহিত্য ও সংস্কৃতি বাসর, এবং চুয়াডাঙ্গা সাংবাদিক ইউনিয়নের তিনি প্রতিষ্ঠাতা। এছাড়া চুয়াডাঙ্গা প্রেসক্লাব, বাংলাদেশ সোভিয়েত মৈত্রী সমিতি ও জেলা শিল্পকলা একাডেমীর মুখ্য কর্মকর্তা হিসেবে দীর্ঘসময় দায়িত্ব পালন করেছেন
তার প্রায় ২৭টি প্রকাশিত গ্রন্থ রয়েছে। শিক্ষা প্রশাসন ও ব্যবস্থাপনার উপর নায়েম, নিয়েয়ার, বিয়াম, এইচটিটিআই থেকে প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত। তিনি ১৯৮৬ সালে চুয়াডাঙ্গা সাহিত্য পরিষদ পদক, ১৯৯২ সালে শ্রেষ্ঠ কলেজ শিক্ষক (নড়াইল জেলা), ১৯৯৭ সেরা শিক্ষা সংগঠক, ১৯৯৮ শ্রেষ্ঠ অধ্যক্ষ (নড়াইল জেলা), ১৯৯৮ সালে মধুসূদন পদক, ১৯৯৮ সালে সেরা প্রশিক্ষণার্থী অধ্যক্ষ (বিয়াম), ২০০৩ সালে গুণী শিক্ষক সম্মাননা, ২০০৪ সালে শ্রেষ্ঠ অধ্যক্ষ (রাজশাহী বিভাগ), ২০০৫ সালে সময়ের সাহসী পিতা পদক, ২০০৯ সালে সেরা অধ্যক্ষ (বিএসবি ফাউন্ডেশন পদক), ২০০৯ সালে ডাঃ লুৎফর রহমান পদক, ২০১০ সালে সাংবাদিক মাসুদ স্মৃতি পদক, ২০০৬ সালে মাওলানা তর্কবাগীশ গুণীজন পদক সম্মাননা লাভ করেন। তিনি বাংলা একাডেমী, এশিয়াটিক সোসাইটি, শিল্পকনা একাডেমী ছাড়াও বহু সামাজিক, সাংস্কৃতিক ও পেশাগত সংগঠনের সাথে জড়িত। দায়িত্বে-কর্তব্যে, সততার স্ব-আন্তরিকতা-ব্যক্তিত্ব-নিষ্ঠার এবং সর্বোপরি একজন কর্মতৎপর মানুষ হিসেবে অধ্যক্ষ হামিদুল হক মুন্সী অল্পদিনের মধ্যে সৃজনশীল মানুষের নজর কেড়েছেন। তাঁর মত গুণী শিক্ষক এবং উদারচিত্তের মানুষ বর্তমানে বিরল। স্বীয় জ্ঞানালোকে তিনি আলোকিত করে চলেছেন এ অঞ্চরের শিক্ষার্থীদের মেধা মননের অন্ধকার কুঠুরী। তাঁর ব্যক্তিত্বের জ্যোতিতে এবং মনোবল ও কর্মের নিষ্ঠায় উৎকর্ষ লাভ করেছে বিভিন্ন অঞ্চলের শিক্ষা প্রতিষ্ঠান ও শিক্ষার্থীরা। তিনি বর্তমানে চাঁদপুর জেলার নাসিরকোট শহীদ স্মতি কলেজের অধ্যক্ষ হিসেবে কর্মরত রয়েছে।
সংবাদদাতা
মুহম্মদ রবীউল আলম
সাপ্তাহিক মুক্তিবাণী
ঢাকা