সৈয়দা রিজওয়ানা হাসান গঙ্গা নদীর ওপর চার দশক ধরে চেপে বসা ফারাক্কা ব্যারাজ ভেঙে ফেলার দাবি খোদ ভারতীয় নীতিনির্ধারকদের কাছ থেকেই ও...
সৈয়দা রিজওয়ানা হাসান
গঙ্গা নদীর ওপর চার দশক ধরে চেপে বসা ফারাক্কা ব্যারাজ ভেঙে ফেলার দাবি খোদ ভারতীয় নীতিনির্ধারকদের কাছ থেকেই ওঠার খবর চাঞ্চল্যকর হলেও আমি খুব বিস্মিত হইনি। কারণ এটাই স্বাভাবিক। আজ হোক, কাল হোক নদী মেরে ফেলার এই দৈত্যকায় আয়োজন নিয়ে প্রশ্ন ওঠাই স্বাভাবিক। প্রথমে ভারতীয় সংবাদমাধ্যমের পর বিবিসির মতো আন্তর্জাতিক সংবাদমাধ্যম ও বাংলাদেশি সংবাদমাধ্যমগুলো স্বভাবতই এই খবর গুরুত্ব দিয়ে প্রকাশ করেছে। কলকাতা থেকে প্রকাশিত আনন্দবাজার পত্রিকায় বুধবার এ বিষয়ে যে প্রতিবেদন ছাপা হয়েছে সেখানে বলা হয়েছে, বিহারের মুখ্যমন্ত্রী নীতিশ কুমার প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদিকে একটি স্মারকলিপি হস্তান্তর করেছেন। সেখানে তিনি যথার্থই বলেছেন, বিহারের গঙ্গা অববাহিকায় প্রায় প্রতি বছর বন্যা ও বন্যাকবলিত এলাকা সম্প্রসারিত হওয়ার জন্য ফারাক্কা ব্যারাজই দায়ী। এই ব্যারাজের কারণেই গঙ্গার পলি সমুদ্রের দিকে অপসারিত হচ্ছে না। ফলে গভীরতা কমছে এবং অল্পতেই দুকূল ছাপিয়ে যাচ্ছে।
বিষয়টিকে যদি বাংলাদেশ থেকে দেখি- প্রথমত, সরাসরি ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির কাছে ফারাক্কা ব্যারাজ সরিয়ে ফেলার দাবি দেশটির ‘ড্যাম-হ্যাপি’ কর্তৃপক্ষের জন্য একটি উপযুক্ত শিক্ষা। সত্তরের দশকে এই ব্যারাজ যখন চালু করা হয়েছিল, তখন বাংলাদেশের দিক থেকে আপত্তি তুলে এসব কথাই বলা হয়েছিল। বলা হয়েছিল যে, ফারাক্কা দীর্ঘমেয়াদে কেবল বাংলাদেশের নয়, ভারতেও বিরূপ প্রভাব সৃষ্টি করবে। কিন্তু তারা তখন সেটা কানে তোলেনি। দাবিটি একটি প্রদেশের শীর্ষ স্থানীয় রাজনীতিকদের কাছ থেকে উঠলেও কারিগরিভাবে এটাকে বলা যেতে পারে ‘নির্মাণ-পরবর্তী বিরূপ প্রভাব নিরূপণ’। ফারাক্কা ব্যারাজ নির্মাণের চার দশক পর গবেষণা করে নয়, খালি চোখেই দেখা যাচ্ছে যে তারা কী ধরনের ক্ষয়ক্ষতির সম্মুখীন হচ্ছে। মনে রাখতে হবে, পরিবেশগত প্রভাবের প্রশ্নেই মণিপুরের টিপাইমুখ ড্যাম প্রকল্প আটকে রয়েছে। তবে সেখানে করা হয়েছে ‘পরিবেশগত প্রভাব নিরূপণ’ বা ইআইএ। ফারাক্কা ব্যারাজ নির্মাণের আগেও যদি সুষ্ঠু ইআইএ করা হতো এবং তা মেনে চলা হতো, তাহলে এই নদী মেরে ফেলা এই স্থাপনা নির্মিতই হতে পারত না। বিহারের মুখ্যমন্ত্রীর যৌক্তিক দাবির মধ্য দিয়ে বিলম্বে হলেও প্রমাণ হলো যে, ব্যারাজটির পরিবেশগত কুপ্রভাব কতটা ভয়ানক এবং তারা এখন বুঝতে পারছেন।
দ্বিতীয়ত, ফারাক্কা ব্যারাজের বিরুদ্ধে খোদ ভারত থেকেই অভিযোগ যে বিহারের মুখ্যমন্ত্রীই প্রথম তুললেন, এমন নয়। অনেকের মনে থাকার কথা, ২০১৪ সালের ডিসেম্বরে পশ্চিমবঙ্গের নয়জন নাগরিক সে দেশের ন্যাশনাল গ্রিন ট্রাইব্যুনালে অভিযোগ দায়ের ও ক্ষতিপূরণ দাবি করেছিলেন। তাদের মধ্যে পরিবেশকর্মী ও মৎস্যজীবীও রয়েছেন। তাদের অভিযোগ, ফারাক্কা ব্যারাজ ভৌগোলিক, অর্থনৈতিক ও পরিবেশগত ক্ষতি করছে। এর প্রভাব পড়ছে জনজীবনে। বস্তুত এমন অভিযোগ ফারাক্কা ব্যারাজ যে দুই জেলায় অবস্থিত সেই মালদহ ও মুর্শিদাবাদের সাধারণ মানুষের কাছে গেলেও পাওয়া যাবে। ওই অঞ্চলের ব্যারাজের প্রভাবে নদীভাঙন বেড়ে গেছে; তার জের ধরে হাজার হাজার মানুষ বাস্তুচ্যুত হচ্ছে ও জীবিকা হারাচ্ছে। ব্যারাজের ভাটিতে বাংলাদেশ অংশের পরিস্থিতি আরও গুরুতর, বলা বাহুল্য। এর প্রভাবে গঙ্গা নদীর বাংলাদেশ অংশে নৌপরিবহন ব্যবস্থা ধ্বংস হয়েছে, ভাঙন বেড়েছে। নদীতে চর পড়েছে, মৎস্যসম্পদ বিনষ্ট হয়েছে, ভূগর্ভস্থ পানিস্তর নিচে নেমে গিয়েছে। প্রবাহশূন্যতার প্রভাব পড়েছে গঙ্গার শাখা নদীগুলোতে। গঙ্গা-কপোতাক্ষ সেচ প্রকল্প অকার্যকর তো বটেই, আরও ক্ষুদ্র ও অনানুষ্ঠানিক সেচ ব্যবস্থা ধ্বংস হয়েছে। প্রবাহ স্বল্পতা ও শূন্যতার কারণে সুন্দরবন প্রয়োজনীয় মিঠা পানি পাচ্ছে না। লবণাক্ততার প্রভাব বাড়ছে। প্রসঙ্গত, ভারতের দিক থেকে কেউ কেউ বলার চেষ্টা করেন যে বাংলাদেশ থেকে নদী খাত ধরে বঙ্গোপসাগরে যাওয়া পানি আসলে ‘অপচয়’ হচ্ছে। অথচ এটা সম্পূর্ণ অবৈজ্ঞানিক ধারণা। কারণ নদীপ্রবাহের কারণেই বাংলাদেশের কৃষি, নৌ পরিবহন, মৎস্যসম্পদ, সেচ ব্যবস্থা ঠিক থাকছে, লবণাক্ততা নিয়ন্ত্রণে থাকছে, ব-দ্বীপ সম্প্রসারণ অব্যাহত রয়েছে। পানির তথাকথিত ‘অপচয়’ রোধে ফারাক্কার মতো ব্যারাজ তৈরি গোটা বাংলাদেশকেই অপচয়ের অপচেষ্টা ছাড়া আর কিছু নয়। এসব কথা আমরা বছরের পর বছর বলে গেছি; এখন ভারত থেকেও অভিযোগ ওঠা শুরু হয়েছে।
তৃতীয়ত, ফারাক্কা ব্যারাজের উপকারিতা কী? নির্মাণের সময় বলা হয়েছিল যে এর মূল উদ্দেশ্য ভাগীরথী বা হুগলিতে প্রবাহ বৃদ্ধি করে কলকাতা বন্দর সচল রাখা। কিন্তু শেষ পর্যন্ত ফারাক্কা ব্যারাজ কলকাতা বন্দরের জন্য প্রয়োজনীয় প্রবাহ সরবরাহ করতে পারেনি। কল্যাণ রুদ্রের একটি গবেষণাতেই দেখা গেছে যে, ভাগীরথী নদী ক্রমশ নাব্যতা হারিয়েই চলছে। আমরা এখান থেকেই দেখতে পাচ্ছি, শেষ পর্যন্ত কলকাতা বন্দর আরও ভাটিতে হলদিয়ায় স্থানান্তর করতে হয়েছে। এর মধ্যে একটি সান্ত্বনা হতে পারত, ব্যারাজটি দিয়ে বন্যা নিয়ন্ত্রণ সম্ভব হলে। কিন্তু বন্যা নিয়ন্ত্রণেও কাজে আসছে না। বরং বন্যার প্রকোপ বাড়িয়ে তুলেছে। আগে পশ্চিমবঙ্গে বন্যা ঘটাত, এখন সেটা বিহার পর্যন্ত পেঁৗছে গেছে। আর ভাঙন যে বাড়িয়ে চলছে, সেটা আগেই বলেছি। গঙ্গা নদীর চরিত্রই হচ্ছে বিপুল পলি বা সিল্ট উৎপন্ন করা। যে কারণে বলা হয় ‘গাঙ্গেয় ব-দ্বীপ’। ফারাক্কা ব্যারাজ হাজার বছরের সেই প্রাকৃতিক পলি ব্যবস্থাপনাও বিনষ্ট করে দিয়েছে। এখন এর ভাটিতে যেমন, তেমনই উজানেও ভরাট হচ্ছে, চর পড়েছে। গঙ্গার পলি বঙ্গোপসাগরে গিয়ে নতুন ভূমি গঠনে যে অবদান রাখত, তা এখন বন্ধ হয়েছে। তার মানে, ফারাক্কা ব্যারাজ কোনোই কাজে আসছে না। না বন্দর নাব্য রাখতে পেরেছে; না সেচের কাজে আসছে; না বন্যা নিয়ন্ত্রণ করতে পারছে; না পলি ব্যবস্থাপনা করতে পারছে। বরং বাড়িয়ে তুলছে ভরাট প্রক্রিয়া, বন্যা, ভাঙন, লবণাক্ততা, ভূগর্ভস্থ পানিস্তরের ভারসাম্যহীনতা।
চতুর্থত, কেবল আর্থ-সামাজিক, পরিবেশ, প্রতিবেশগত সংকট নয়, ফারাক্কা ব্যারাজের কারণেই বাংলাদেশ ও ভারতের মধ্যে স্বাভাবিক প্রতিবেশীসুলভ সম্পর্ক বিঘি্নত হচ্ছে। এ নিয়ে সীমান্তের দুই পাশেই রাজনীতি হচ্ছে; ফারাক্কার কারণে অন্যান্য অমীমাংসিত ইস্যু চাপা পড়ে যাচ্ছে। ফারাক্কা হয়ে উঠছে বৃহৎ রাষ্ট্র ভারতের দিক থেকে ছোট রাষ্ট্র বাংলাদেশের প্রতি অবিচারের প্রতীক। একই সঙ্গে খবর বের হয়েছে, বিহারের বন্যা সামাল দেওয়ার জন্য ফারাক্কার সবগুলো গেট খুলে দেওয়া হবে। ফলে আমাদের দেশে বন্যার আশঙ্কা রয়েছে। এর মধ্য দিয়েই প্রমাণ হয় না যে, ভাটির দেশ বাংলাদেশের সুবিধা-অসুবিধা নিয়ে উজানের ভারতের কিছু যায় আসে না! তারা যখন খুশি গেট বন্ধ করে দিচ্ছে, যখন খুশি খুলে দিচ্ছে।
পঞ্চমত, বাংলাদেশ কী করতে পারে। আমাদের কেউ কেউ যদিও বলছেন যে, ফারাক্কার সব গেট খুলে দিলে বন্যা হবে না, সেটাতে আমি খুব ভরসা পাই না। আর ভাঙন তো বাড়তেই পারে। বড় কথা হচ্ছে, যখন খুশি পানি আটকিয়ে, যখন খুশি ছেড়ে দেওয়া কোনো যৌক্তিক অবস্থান হতে পারে না। এ ব্যাপারে ঢাকার উচিত জোরের সঙ্গে কথা বলা। আর যে বিষয়টি আমাদের অবশ্যই করা উচিত, তা হচ্ছে জাতিসংঘ পানিপ্রবাহ সনদ ১৯৯৭ অনুসমর্থন করা। ভারত তো ওই সনদের সঙ্গে একমতই ছিল না। সৌভাগ্যবশত বাংলাদেশ তা স্বাক্ষর করেছে; কিন্তু দুর্ভাগ্যবশত সংসদে উত্থাপন করে অনুসমর্থন বা রেটিফাই করছে না। প্রয়োজনীয় ৩৫টি দেশ অনুসমর্থন করায় দলিলটি ইতিমধ্যেই কার্যকর হয়েছে। আমরা যদি অনুসমর্থন করি, তাহলে ফারাক্কা কেবল নয়, অভিন্ন যে কোনো নদীর পানি ব্যবস্থাপনার প্রশ্নে জোরের সঙ্গে অবস্থান নিতে পারব। ওই দলিলে বলা হয়েছে, যদি অভিন্ন নদীর প্রশ্নে দুই দেশ একমত হতে না পারে, তাহলে যে কোনো পক্ষে জাতিসংঘ যেতে পারবে এবং সেখান থেকে তৃতীয় কাউকে মীমাংসার জন্য নিযুক্ত করা যাবে। বড় কথা, এই দলিলে নদীর প্রতিবেশ ও পরিবেশ সুরক্ষিত রাখার জন্য প্রয়োজনীয় প্রবাহ নদীতে রাখার কথা বলা হয়েছে।
ষষ্ঠত, এই পরিস্থিতিতে ভারতের দিক থেকে কী করার রয়েছে? আমরা এতদিন বলেছি, গঙ্গার পানির ন্যায্য হিস্যার কথা। ফারাক্কা ব্যারাজ থেকে পর্যাপ্ত পানি ছাড়া হলে নদীটি বেঁচে থাকত, বাংলাদেশের পরিবেশ ও প্রতিবেশও সুরক্ষিত থাকত। আর্থ-সামাজিক বিপর্যয়ও হতো না। ভারতে ফারাক্কা ব্যারাজ দিয়ে সাময়িক উপকার হলেও দীর্ঘমেয়াদে ক্ষতি হয়েছে। সেই ক্ষতি ক্রমে স্পষ্ট হয়ে উঠছে। যত দিন যাবে, তত বিপর্যয় আরও গভীর ও সম্প্রসারিত হতে থাকবে। আনন্দবাজারের সংবাদ, বিহারের মুখ্যমন্ত্রী নীতিশ কুমার বিষয়টি মূল্যায়নের জন্য একটি বিশেষজ্ঞ দল পাঠানোর দাবি জানালে ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি তা নীতিগতভাবে মেনে নিয়েছেন। আমি মনে করি, ভারতের উচিত হবে বাস্তবতা মেনে নিয়ে, বিলম্বে হলেও ভুল শোধরানোর জন্য ফারাক্কা ব্যারাজ সরিয়ে ফেলা বা ‘ডিকমিশন’ করা। তাতে করে বাংলাদেশ তো উপকৃত হবেই, ভারতও উপকৃত হবে। বাংলাদেশ-ভারত ‘বন্ধুত্বের’ সেটাই হবে উৎকৃষ্ট নিদর্শন।
শেষ করার আগে আরেকটি কথা বলতে চাই। ফারাক্কা ব্যারাজ যখন নির্মিত হয়, তখন এর ‘সুফল’ তুলে ধরার মতো ‘বিশেষজ্ঞ’ কম ছিল না। এখন সময় এসেছে, এমন বিপর্যয়কর ও অপচয়মূলক একটি প্রকল্পের জন্য ভারতের দিক থেকেই তাদের জবাবদিহি করা।
পরিবেশ আইনবিদ; প্রধান নির্বাহী, বেলা