যশোর উন্নয়নের করিগর যশোর জেলা বোর্ড ও পৌরসভার সাবেক চেয়ারম্যান এবং নিজ হাতে প্রতিষ্ঠা করা যশোর ইন্সটিটিউটের প্রথম সাধারণ সম্পাদক রায় বাহাদুর যদুনাথ মজুমদারের আজ ১শ’ ৫৭ তম জন্মদিন ও আগামীকাল ৮৩তম প্রয়াণ দিবস।
এ ক্ষণজন্মা ব্যক্তিত্ব ছিলেন তৎকালীন বৃহত্তর যশোর, তথা যশোরের জনগণের সার্বিক উন্নয়নের কারিগর এবং একাধারে তিনি ছিলেন একজন লেখক, সাংবাদিক, প্রকাশক এবং স্বনামধন্য সমাজসংস্কারক, সংগঠক ও নেতা। যশোর সম্মিলনী ইনস্টিটিউশনসহ বিভিন্ন শিক্ষা ও সামাজিক প্রতিষ্ঠানের প্রতিষ্ঠা করাসহ তৎকালীন বৃহত্তর যশোরের সাধারণ জনগনের সার্বিক উন্নয়নের কারিগর হওয়া সত্বেও কেউ তার জন্ম বা মৃত্যু বার্ষিকীতে কোন কার্যসূচি হাতে নেয়নি।
পৃথিবীতে খুব কম সংখ্যক মানুষ আছেন যারা মানব কল্যাণে কাজ করে মৃত্যুর পরেও অবিস্মরণীয় মর্যাদায় বিভূষিত হন, সেই সব ক্ষণজন্মা মণিষীদের মত অবিস্মরণীয় মর্যাদার অধিকারী একজন প্রখ্যাত আইনজীবী, বিদ্যানুরাগী, বাগ্মী, সুপন্ডিত এবং সাহিত্যিক রায় বাহাদুর যদুনাথ মজুমদার। তিনি ১৮৫৯ সালের ২৩ অক্টোবর বৃহত্তম যশোর জেলার নড়াইলের লোহাগড়া গ্রামে এক সম্ভ্রান্ত বংশে জন্মেছিলেন।
রায় রাহাদুর যদুনাথ মজুমদার ছিলেন এক অনন্য ব্যক্তিত্ব। তিনি বাংলা ও ইংরেজীর পাশাপাশি সংস্কৃত, হিন্দী, উর্দু, গুর্খা, গুরুমুখী, উড়িয়া প্রভৃতি ভাষায় পারদর্শী ছিলেন। এছাড়া বেদবেদান্তাদিতে তিনি একজন সুপন্ডিত ছিলেন। শিক্ষা জীবনে যদুনাথ কোলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় হতে ইংরেজী ভাষা ও সাহিত্যে এম এ ডিগ্রী লাভ করেন। বিশ্ববিদ্যালয়ের পড়া শেষে তিনি কিছুদিন শিক্ষক হিসাবে দায়িত্ব পালন করেন। কাশ্মীরে থাকা অবস্থায় তিনি আইন বিষয়ে স্নাতক ডিগ্রী লাভ করেন।
১৮৮৩ সালে যদুনাথ ও ড. যগেন্দ্রনাথ একযোগে ‘দি ইউনাইটেড ইন্ডিয়া’ নামে একটি ইংরেজী সাপ্তাহিক সংবাদপত্র সম্পাদনা করেন। নিজের পত্রিকায় লেখার পাশাপাশি তিনি নিয়মিত ‘স্টেটসম্যান’, ‘হিন্দু পেট্রিয়ট’ ও ‘অমৃতবাজার’ পত্রিকায় অনেক প্রবন্ধ লিখতেন। এরপর কিছুদিনের জন্য শিক্ষকতা পরিত্যাগ করে ‘ট্রিবিউন’ পত্রিকার সম্পাদক হয়ে লাহোরে চলে যান।
দৈনিক ‘ট্রিবিউন’ সম্পাদক থাকা অবস্থায় নেপালের মন্ত্রী স্যার মহারাজা রনদীপ শিং জঙ্গী বাহাদুর তাকে নেপালের রাজপ্রাসাদ স্কুলের প্রধান শিক্ষক হিসেবে নিযুক্ত করেন। কিন্তু রাজনৈতিক কোন্দলের কারণে তিনি নেপাল ত্যাগ করেন এবং দৈনিক ‘ট্রিবিউন’ পত্রিকার সম্পাদক পদে পুনর্বহাল হন। তারপর রাজ্যমন্ত্রী নিলাম্বর মুখার্জীর আমন্ত্রণে তিনি কাশ্মীর সরকারের রাজস্ব সচিবের পদ গ্রহণ করেন। পরবর্তীতে কাশ্মীর সরকারের চাকরি ছেড়ে দিয়ে যশোরে এসে ওকালতি শুরু করেন।
এসময় তিনি যশোরের একজন সুযোগ্য জননেতা এবং বিজ্ঞ উকিল হিসেবে প্রতিষ্ঠা লাভ করেন। তিনি ইউরোপীয় নীল ব্যবসায়ীদের দ্বারা নির্যাতিত চাষীদের হয়ে মামলায় লড়তেন। এছাড়াও তিনি এইসব নির্যাতনের চিত্র পত্র পত্রিকায় বিভিন্ন লেখার মাধ্যমে তুলে ধরতেন এবং উর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের কাছেও এ বিষয়ে ব্যবস্থা নেওয়ার জন্যে লিখিতভাবে অনুরোধ জানাতেন। দেশের যেকোন সমস্যার সমাধানার্থে নিজের পত্রিকা ছাড়াও বিভিন্ন পত্রিকায় চিন্তামূলক প্রবন্ধ লিখতেন। তিনিই সর্বপ্রথম তৎকালীন ভারতের জেলা বোর্ডে বেসরকারী চেয়ারম্যান নিয়োগ সম্বন্ধে ‘অমৃত বাজার’ পত্রিকায় সমালোচনা করেন।
১৮৮৯-৯০ খৃষ্টাব্দে যশোরে নীলকর সাহেবদের অত্যাচারে জনগণ অতিষ্ট হয়ে উঠলে তিনি অত্যাচারিত প্রজাগণের পক্ষ অবলম্বন করে ব্রাডলী সাহেবের দ্বারা নীলকরদের অত্যাচারের কাহিনী ব্রিটিশ পার্লামেন্টে উত্থাপন করান এবং পার্লামেন্ট ভারত সরকারের কাছে কৈফিয়ত তলব করেন। তারপর থেকে নীলকরদের অত্যাচার প্রশমিত হয় এবং এতদঞ্চলে নীলচাষ বন্ধ হয়ে যায়। আইনগত পদ্ধতিতে নীলকরদের হাত থেকে এদেশবাসীকে বাঁচিয়ে ইতিহাসে অমর হয়ে আছেন এই খ্যাতনামা আইনজীবী।
তিনি যশোরে ওকালতি শুরু করার পর জনকল্যাণমূলক বিভিন্ন বিষয় আলোচনার জন্য একটি ফোরাম গঠন করার উদ্দেশ্যে ‘সম্মিলনী’ নামে একটি পত্রিকা প্রকাশ করেন। পরে তিনি ‘বৈশ্যবারুজীবী’ নামক আরো একখানি পত্রিকা প্রকাশ করেছিলেন।
যদুনাথ মজুমদার ১৯০৪ এর ১৬ সেপ্টেম্বর থেকে ১৯০৭ সালের ২৩ নভেম্বর পর্যন্ত যশোর জেলা বোর্ড এবং পৌরসভার চেয়ারম্যান হিসাবে দায়িত্ব পালন করেন। এই সময়ে তিনি বিভিন্ন জনহিতকর কর্মকান্ডে অংশগ্রহণ করেন। ম্যালেরিয়া, কলেরা, বসন্ত এবং ইনফ্লুয়েঞ্জার মত ঘাতক ব্যাধির আক্রমণ থেকে দেশবাসীকে রক্ষা করার জন্য ‘পল্ল¬ী স্বাস্থ্য’ নামক একখানি ক্ষুদ্র পুস্তক প্রকাশ করে জনসাধারণকে স্বাস্থ্যরক্ষা বিষয়ক শিক্ষা কার্যক্রমে উদ্বুদ্ধ করেন। এসবের বিরুদ্ধে গণসচেতনতা সৃষ্টিতে ব্যাপক প্রচারণার পাশাপাশি যশোর শহরে বিশুদ্ধ পানি সরবরাহের ব্যবস্থা করেন এবং এসময় তিনি যশোরে টাউনহল নির্মাণ করেন।
তিনি নিজে যেমন একজন বিদ্যান ব্যাক্তি ছিলেন, তেমনি বিদ্যোৎসাহী ব্যাক্তিও ছিলেন। যশোর জেলা বোর্ডের চেয়ারম্যান হিসাবে তিনি অসংখ্য প্রাথমিক এবং উচ্চবিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা করে দেশবাসীর বিদ্যার্জনের পথ সুগম করে গিয়েছেন। নারী শিক্ষা সম্প্রসারনে তিনি বেশ কিছু মেয়েদের স্কুলও প্রতিষ্ঠা করেন। ১৮৮৯ খৃষ্টাব্দে তিনি যশোর সম্মিলনী ইনস্টিটিউশন নামক উচ্চ বিদ্যালয়টি প্রতিষ্ঠা করেন। পরবর্তীকালে তার লোহাগড়ার বাড়িতে লোহাগড়া আদর্শ মহাবিদ্যালয় (মডেল কলেজ) এবং তার যশোর শহরস্থ বাড়িতে আদর্শ উচ্চ বালিকা বিদ্যালয় (মডেল গার্লস স্কুল) স্থাপিত হয়েছে। তার প্রচেষ্টায় লোহাগড়া উচ্চ বিদ্যালয়, যশোরের সুফলাকাটী হাই স্কুল, রাজঘাট হাই স্কুল, বরিশালের কদমতলা হাইস্কুল প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। যশোর বোর্ডের চেয়ারম্যান থাকাকালে তিনি কিছু প্রাইমারী, এস. ই. হাইস্কুল ও কয়েকটি বালিকা বিদ্যালয় স্থাপন করতে সাহায্য করেন। তারই প্রচেষ্টায় যশোরে বঙ্গীয় সাহিত্য সম্মেলনের নবম অধিবেশন সংগঠিত হয়। ১৯০২ সালে ইংরেজ সরকার তাঁকে ‘রায় বাহাদুর’ উপাধিতে ভূষিত করেন।
অমিত প্রতিভাধর রায় বাহাদুর যদুনাথ মজুমদার একজন শক্তিশালী সাহিত্যিক হিসেবেও পরিচিত ছিলেন। তিনি দর্শন, ধর্মতত্ত্ব, রাজনীতি, সমাজতত্ত্ব, স্বাস্থ্যতত্ত্ব প্রভৃতি বিষয়ে বহু উৎকৃষ্ট গ্রন্থ প্রণয়ন করেন। তার কিছু বিখ্যাত গ্রন্থ হল ‘পরিব্রাজক’, ‘শ্রেয়া এবং প্রিয়া’, ‘উপবাস’ এবং ‘পল¬ীস্বাস্থ্য’। তাঁর রচিত গ্রন্থাবলী পন্ডিত মহলে বিশেষ জনপ্রিয়তা অর্জন করেছিল। তার রচিত অন্যান্য গ্রন্থগুলির মধ্যে আছে ‘আমিত্বের প্রসার’, ‘ব্রহ্মসুত্র’, ‘পরিব্রাজক যুক্তমালা’, ‘সাংখ্যকারিকা’, ‘শান্তিল্যসুত্র’, ‘নরগাথা’, ‘শ্রেয় ও প্রেয়’ ইত্যাদি। তিনি বেশ কিছু গ্রন্থ ইংরেজীতেও অনুবাদ করেছেন, তার মধ্যে উলে¬খযোগ্য হল ‘ব্রহ্মসুত্র’। তার ইংরেজীতে অনূদিত সান্ধিল্য সুত্র পশ্চিমা পন্ডিতরাও সাগ্রহে গ্রহণ করেছেন।
হিন্দুত্ববাদের মৌলিক বিষয়ে আলোকপাত করার জন্য তিনি ‘হিন্দু পত্রিকা’ প্রকাশ করেন এবং পত্রিকাটিতে হিন্দু শাস্ত্রের মর্ম ব্যাখ্যা করে শাস্ত্রের প্রতি শিক্ষিত হিন্দু সমাজের দৃষ্টি আকর্ষণ করে তাদের ধর্মগ্রন্থের বিষয়ে আগ্রহী করে তোলেন। তিনি ইংরেজী ভাষায় ‘ব্রহ্মচারী’ রচনা করেন এবং ‘বৈশ্ববারুজীবি’ নামে আরো একটি প্রত্রিকা প্রকাশ করেন। ‘হিন্দু পত্রিকা’র ন্যায় তিনি ইংরেজীতে ‘ব্রহ্মচারী’ পত্রিকা প্রকাশ করেন। ‘হিন্দু পত্রিকা’ ও ‘ব্রহ্মচারী পত্রিকা’র জন্য বিভিন্ন ধর্মপ্রচারক সন্নাসীগণ ও পাশ্চাত্য বিদ্যায় সুপন্ডিত ব্যাক্তিবর্গ যদুনাথের প্রশংসা করেছিলেন।
এই কর্মবীর ১৯৩২ সালের ২৪ অক্টোবর ৭৪ বছর বয়সে মাগুরা জেলার দয়ালপুরে মৃত্যুবরণ করেন।
এ ক্ষণজন্মা ব্যক্তিত্ব ছিলেন তৎকালীন বৃহত্তর যশোর, তথা যশোরের জনগণের সার্বিক উন্নয়নের কারিগর এবং একাধারে তিনি ছিলেন একজন লেখক, সাংবাদিক, প্রকাশক এবং স্বনামধন্য সমাজসংস্কারক, সংগঠক ও নেতা। যশোর সম্মিলনী ইনস্টিটিউশনসহ বিভিন্ন শিক্ষা ও সামাজিক প্রতিষ্ঠানের প্রতিষ্ঠা করাসহ তৎকালীন বৃহত্তর যশোরের সাধারণ জনগনের সার্বিক উন্নয়নের কারিগর হওয়া সত্বেও কেউ তার জন্ম বা মৃত্যু বার্ষিকীতে কোন কার্যসূচি হাতে নেয়নি।
পৃথিবীতে খুব কম সংখ্যক মানুষ আছেন যারা মানব কল্যাণে কাজ করে মৃত্যুর পরেও অবিস্মরণীয় মর্যাদায় বিভূষিত হন, সেই সব ক্ষণজন্মা মণিষীদের মত অবিস্মরণীয় মর্যাদার অধিকারী একজন প্রখ্যাত আইনজীবী, বিদ্যানুরাগী, বাগ্মী, সুপন্ডিত এবং সাহিত্যিক রায় বাহাদুর যদুনাথ মজুমদার। তিনি ১৮৫৯ সালের ২৩ অক্টোবর বৃহত্তম যশোর জেলার নড়াইলের লোহাগড়া গ্রামে এক সম্ভ্রান্ত বংশে জন্মেছিলেন।
রায় রাহাদুর যদুনাথ মজুমদার ছিলেন এক অনন্য ব্যক্তিত্ব। তিনি বাংলা ও ইংরেজীর পাশাপাশি সংস্কৃত, হিন্দী, উর্দু, গুর্খা, গুরুমুখী, উড়িয়া প্রভৃতি ভাষায় পারদর্শী ছিলেন। এছাড়া বেদবেদান্তাদিতে তিনি একজন সুপন্ডিত ছিলেন। শিক্ষা জীবনে যদুনাথ কোলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় হতে ইংরেজী ভাষা ও সাহিত্যে এম এ ডিগ্রী লাভ করেন। বিশ্ববিদ্যালয়ের পড়া শেষে তিনি কিছুদিন শিক্ষক হিসাবে দায়িত্ব পালন করেন। কাশ্মীরে থাকা অবস্থায় তিনি আইন বিষয়ে স্নাতক ডিগ্রী লাভ করেন।
১৮৮৩ সালে যদুনাথ ও ড. যগেন্দ্রনাথ একযোগে ‘দি ইউনাইটেড ইন্ডিয়া’ নামে একটি ইংরেজী সাপ্তাহিক সংবাদপত্র সম্পাদনা করেন। নিজের পত্রিকায় লেখার পাশাপাশি তিনি নিয়মিত ‘স্টেটসম্যান’, ‘হিন্দু পেট্রিয়ট’ ও ‘অমৃতবাজার’ পত্রিকায় অনেক প্রবন্ধ লিখতেন। এরপর কিছুদিনের জন্য শিক্ষকতা পরিত্যাগ করে ‘ট্রিবিউন’ পত্রিকার সম্পাদক হয়ে লাহোরে চলে যান।
দৈনিক ‘ট্রিবিউন’ সম্পাদক থাকা অবস্থায় নেপালের মন্ত্রী স্যার মহারাজা রনদীপ শিং জঙ্গী বাহাদুর তাকে নেপালের রাজপ্রাসাদ স্কুলের প্রধান শিক্ষক হিসেবে নিযুক্ত করেন। কিন্তু রাজনৈতিক কোন্দলের কারণে তিনি নেপাল ত্যাগ করেন এবং দৈনিক ‘ট্রিবিউন’ পত্রিকার সম্পাদক পদে পুনর্বহাল হন। তারপর রাজ্যমন্ত্রী নিলাম্বর মুখার্জীর আমন্ত্রণে তিনি কাশ্মীর সরকারের রাজস্ব সচিবের পদ গ্রহণ করেন। পরবর্তীতে কাশ্মীর সরকারের চাকরি ছেড়ে দিয়ে যশোরে এসে ওকালতি শুরু করেন।
এসময় তিনি যশোরের একজন সুযোগ্য জননেতা এবং বিজ্ঞ উকিল হিসেবে প্রতিষ্ঠা লাভ করেন। তিনি ইউরোপীয় নীল ব্যবসায়ীদের দ্বারা নির্যাতিত চাষীদের হয়ে মামলায় লড়তেন। এছাড়াও তিনি এইসব নির্যাতনের চিত্র পত্র পত্রিকায় বিভিন্ন লেখার মাধ্যমে তুলে ধরতেন এবং উর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের কাছেও এ বিষয়ে ব্যবস্থা নেওয়ার জন্যে লিখিতভাবে অনুরোধ জানাতেন। দেশের যেকোন সমস্যার সমাধানার্থে নিজের পত্রিকা ছাড়াও বিভিন্ন পত্রিকায় চিন্তামূলক প্রবন্ধ লিখতেন। তিনিই সর্বপ্রথম তৎকালীন ভারতের জেলা বোর্ডে বেসরকারী চেয়ারম্যান নিয়োগ সম্বন্ধে ‘অমৃত বাজার’ পত্রিকায় সমালোচনা করেন।
১৮৮৯-৯০ খৃষ্টাব্দে যশোরে নীলকর সাহেবদের অত্যাচারে জনগণ অতিষ্ট হয়ে উঠলে তিনি অত্যাচারিত প্রজাগণের পক্ষ অবলম্বন করে ব্রাডলী সাহেবের দ্বারা নীলকরদের অত্যাচারের কাহিনী ব্রিটিশ পার্লামেন্টে উত্থাপন করান এবং পার্লামেন্ট ভারত সরকারের কাছে কৈফিয়ত তলব করেন। তারপর থেকে নীলকরদের অত্যাচার প্রশমিত হয় এবং এতদঞ্চলে নীলচাষ বন্ধ হয়ে যায়। আইনগত পদ্ধতিতে নীলকরদের হাত থেকে এদেশবাসীকে বাঁচিয়ে ইতিহাসে অমর হয়ে আছেন এই খ্যাতনামা আইনজীবী।
তিনি যশোরে ওকালতি শুরু করার পর জনকল্যাণমূলক বিভিন্ন বিষয় আলোচনার জন্য একটি ফোরাম গঠন করার উদ্দেশ্যে ‘সম্মিলনী’ নামে একটি পত্রিকা প্রকাশ করেন। পরে তিনি ‘বৈশ্যবারুজীবী’ নামক আরো একখানি পত্রিকা প্রকাশ করেছিলেন।
যদুনাথ মজুমদার ১৯০৪ এর ১৬ সেপ্টেম্বর থেকে ১৯০৭ সালের ২৩ নভেম্বর পর্যন্ত যশোর জেলা বোর্ড এবং পৌরসভার চেয়ারম্যান হিসাবে দায়িত্ব পালন করেন। এই সময়ে তিনি বিভিন্ন জনহিতকর কর্মকান্ডে অংশগ্রহণ করেন। ম্যালেরিয়া, কলেরা, বসন্ত এবং ইনফ্লুয়েঞ্জার মত ঘাতক ব্যাধির আক্রমণ থেকে দেশবাসীকে রক্ষা করার জন্য ‘পল্ল¬ী স্বাস্থ্য’ নামক একখানি ক্ষুদ্র পুস্তক প্রকাশ করে জনসাধারণকে স্বাস্থ্যরক্ষা বিষয়ক শিক্ষা কার্যক্রমে উদ্বুদ্ধ করেন। এসবের বিরুদ্ধে গণসচেতনতা সৃষ্টিতে ব্যাপক প্রচারণার পাশাপাশি যশোর শহরে বিশুদ্ধ পানি সরবরাহের ব্যবস্থা করেন এবং এসময় তিনি যশোরে টাউনহল নির্মাণ করেন।
তিনি নিজে যেমন একজন বিদ্যান ব্যাক্তি ছিলেন, তেমনি বিদ্যোৎসাহী ব্যাক্তিও ছিলেন। যশোর জেলা বোর্ডের চেয়ারম্যান হিসাবে তিনি অসংখ্য প্রাথমিক এবং উচ্চবিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা করে দেশবাসীর বিদ্যার্জনের পথ সুগম করে গিয়েছেন। নারী শিক্ষা সম্প্রসারনে তিনি বেশ কিছু মেয়েদের স্কুলও প্রতিষ্ঠা করেন। ১৮৮৯ খৃষ্টাব্দে তিনি যশোর সম্মিলনী ইনস্টিটিউশন নামক উচ্চ বিদ্যালয়টি প্রতিষ্ঠা করেন। পরবর্তীকালে তার লোহাগড়ার বাড়িতে লোহাগড়া আদর্শ মহাবিদ্যালয় (মডেল কলেজ) এবং তার যশোর শহরস্থ বাড়িতে আদর্শ উচ্চ বালিকা বিদ্যালয় (মডেল গার্লস স্কুল) স্থাপিত হয়েছে। তার প্রচেষ্টায় লোহাগড়া উচ্চ বিদ্যালয়, যশোরের সুফলাকাটী হাই স্কুল, রাজঘাট হাই স্কুল, বরিশালের কদমতলা হাইস্কুল প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। যশোর বোর্ডের চেয়ারম্যান থাকাকালে তিনি কিছু প্রাইমারী, এস. ই. হাইস্কুল ও কয়েকটি বালিকা বিদ্যালয় স্থাপন করতে সাহায্য করেন। তারই প্রচেষ্টায় যশোরে বঙ্গীয় সাহিত্য সম্মেলনের নবম অধিবেশন সংগঠিত হয়। ১৯০২ সালে ইংরেজ সরকার তাঁকে ‘রায় বাহাদুর’ উপাধিতে ভূষিত করেন।
অমিত প্রতিভাধর রায় বাহাদুর যদুনাথ মজুমদার একজন শক্তিশালী সাহিত্যিক হিসেবেও পরিচিত ছিলেন। তিনি দর্শন, ধর্মতত্ত্ব, রাজনীতি, সমাজতত্ত্ব, স্বাস্থ্যতত্ত্ব প্রভৃতি বিষয়ে বহু উৎকৃষ্ট গ্রন্থ প্রণয়ন করেন। তার কিছু বিখ্যাত গ্রন্থ হল ‘পরিব্রাজক’, ‘শ্রেয়া এবং প্রিয়া’, ‘উপবাস’ এবং ‘পল¬ীস্বাস্থ্য’। তাঁর রচিত গ্রন্থাবলী পন্ডিত মহলে বিশেষ জনপ্রিয়তা অর্জন করেছিল। তার রচিত অন্যান্য গ্রন্থগুলির মধ্যে আছে ‘আমিত্বের প্রসার’, ‘ব্রহ্মসুত্র’, ‘পরিব্রাজক যুক্তমালা’, ‘সাংখ্যকারিকা’, ‘শান্তিল্যসুত্র’, ‘নরগাথা’, ‘শ্রেয় ও প্রেয়’ ইত্যাদি। তিনি বেশ কিছু গ্রন্থ ইংরেজীতেও অনুবাদ করেছেন, তার মধ্যে উলে¬খযোগ্য হল ‘ব্রহ্মসুত্র’। তার ইংরেজীতে অনূদিত সান্ধিল্য সুত্র পশ্চিমা পন্ডিতরাও সাগ্রহে গ্রহণ করেছেন।
হিন্দুত্ববাদের মৌলিক বিষয়ে আলোকপাত করার জন্য তিনি ‘হিন্দু পত্রিকা’ প্রকাশ করেন এবং পত্রিকাটিতে হিন্দু শাস্ত্রের মর্ম ব্যাখ্যা করে শাস্ত্রের প্রতি শিক্ষিত হিন্দু সমাজের দৃষ্টি আকর্ষণ করে তাদের ধর্মগ্রন্থের বিষয়ে আগ্রহী করে তোলেন। তিনি ইংরেজী ভাষায় ‘ব্রহ্মচারী’ রচনা করেন এবং ‘বৈশ্ববারুজীবি’ নামে আরো একটি প্রত্রিকা প্রকাশ করেন। ‘হিন্দু পত্রিকা’র ন্যায় তিনি ইংরেজীতে ‘ব্রহ্মচারী’ পত্রিকা প্রকাশ করেন। ‘হিন্দু পত্রিকা’ ও ‘ব্রহ্মচারী পত্রিকা’র জন্য বিভিন্ন ধর্মপ্রচারক সন্নাসীগণ ও পাশ্চাত্য বিদ্যায় সুপন্ডিত ব্যাক্তিবর্গ যদুনাথের প্রশংসা করেছিলেন।
এই কর্মবীর ১৯৩২ সালের ২৪ অক্টোবর ৭৪ বছর বয়সে মাগুরা জেলার দয়ালপুরে মৃত্যুবরণ করেন।
0 coment rios: