ফারাক্কা আর মিনি ফারাক্কার মাধ্যমে ভারতের একতরফা পানি প্রত্যাহারে শুষ্ক মৌসুমে বাংলাদেশের দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলে পদ্মার শাখা নদ-নদীর অবস্থা শ...
ফারাক্কা আর মিনি ফারাক্কার মাধ্যমে ভারতের একতরফা পানি প্রত্যাহারে শুষ্ক মৌসুমে বাংলাদেশের দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলে পদ্মার শাখা নদ-নদীর অবস্থা শোচনীয় হয়ে পড়েছে। দ্রুত শুকিয়ে মুমূর্ষু খালে পরিণত হচ্ছে একসময়ের স্রোতস্বিনী ও প্রমত্তা সব নদী। খাল-বিলে পানি নেই। কৃষি ও পরিবেশ মারাত্মক হুমকির মুখে। সকল অর্থনৈতিক কর্মকা-ে পড়ছে নেতিবাচক প্রভাব। বদলে যাচ্ছে আবহাওয়া। পরিবর্তন ঘটছে ষড়ঋতুর। বিশ্বের বৃহত্তম ম্যানগ্রোভ ফরেস্ট সুন্দরবন হুমকির মুখে। দেশের বৃহত্তম গঙ্গা কপোতাক্ষ সেচ প্রকল্পের (জিকে প্রজেক্ট) অস্তিত্ব বিপন্ন। দ্বিতীয় সমুদ্রবন্দর মংলা ও নদী বন্দর নওয়াপাড়া মারাত্মক সংকটে। যশোর, খুলনা, ঝিনাইদহ ও কুষ্টিয়াসহ গোটা দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের অপূরণীয় ক্ষতি হচ্ছে। লবণাক্ততা গ্রাস করায় ক্রমেই উপকূলীয় বিস্তীর্ণ এলাকা হচ্ছে বিরাণভূমি। মরুকরণ প্রক্রিয়া হচ্ছে মারাত্মক। প্রতিমুহূর্তে নানাভাবে খেসারত দিতে হচ্ছে দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের বিশাল জনগোষ্ঠীকে। মানুষের অন্যতম মৌলিক অধিকার পানি প্রাপ্তির নিশ্চয়তা। ক্রমেই তা কঠিন হয়ে পড়ছে। কৃষি, শিল্প, ব্যবসা-বাণিজ্য, অর্থনীতি, জীব-বৈচিত্র, বনজ ও মৎসসম্পদ এবং পরিবেশ রক্ষায় নদ-নদীর গুরুত্ব অপরিসীম। সংশ্লিষ্ট একাধিক সূত্রে জানা গেছে, চলতি শুষ্ক মৌসুমের শুরুতেই দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলে পদ্মার শাখা নদ-নদীর অবস্থা শোচনীয় হয়ে পড়েছে। প্রায় সব নদ-নদী পরিণত হয়েছে মুমূর্ষু খালে। অনেক নদী অস্তিত্ব হারাতে বসেছে। শুষ্ক মৌসুমকে বলা হয়ে থাকে ‘বিপজ্জনক মৌসুম’। সেচনির্ভর চাষাবাদ কঠিন হচ্ছে। নদ-নদী ও খাল-বিলে পর্যাপ্ত পানি না থাকায় কৃষকদের দোনা ও সেউতি পদ্ধতিতে সেচ দিয়ে চাষাবাদ করার সুযোগ নেই। অতিরিক্ত খরচ করে ভূগর্ভস্থ পানি উত্তোলন করে কৃষিকাজ করতে হচ্ছে। এতে ক্রমাগতভাবে চাপ পড়ছে মাটিরতলার মূল্যবান পানি সম্পদের ওপর। ভূগর্ভস্থ পানির স্তরও নিচে নেমে গিয়ে উদ্বেগজনক পরিস্থিতির সৃষ্টি হচ্ছে। কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তর, পানি উন্নয়ন বোর্ড ও হাইড্রোলজি বিভাগসহ সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা গেছেÑ যশোর, খুলনা, ঝিনাইদহ, মাগুরা, কুষ্টিয়া, নড়াইল, চুয়াডাঙ্গা ও সাতক্ষীরাসহ গোটা দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলে মোট ১১০টি শাখা-প্রশাখা নদ-নদী রয়েছে। নদ-নদী ছাড়াও ১ হাজার ৭৮১টি খাল-বিল ও ৯৫ হাজার ৮৭৯টি পুকুর দীঘির সিংহভাগই এখন প্রায় পানিশূন্য। দ্রুত শুকিয়ে যাচ্ছে একসময়ের স্রোতস্বিনী ও প্রমত্তা এসব নদ-নদী। এই অঞ্চলের ২২ হাজার ৭৪০ বর্গকিলোমিটার ও দেশের ৩৭ শতাংশ এলাকার প্রাকৃতিক ভারসাম্য নির্ভরশীল মাথাভাঙ্গা, গড়াই, ভৈরব, আপার ভৈরব, কুমার, মধুমতি, ফটকি, বেতাই, চিত্রা, কপোতাক্ষ ও নবগঙ্গাসহ পদ্মার শাখা-প্রশাখা এবং অভিন্ন নদ-নদীর ওপর। ভারতের একতরফা পানি প্রত্যাহার এবং নদী খনন ও সংস্কারের অভাবে উর্বর এই জনপদ এখন মহাবিপর্যয়ের মুখে। পানির ন্যায্য হিস্যা আদায় এবং নদ-নদীর প্রাণ রক্ষায় উল্লেখযোগ্য ব্যবস্থা নেয়ার বিষয়টি বরাবরই অনুপস্থিত থাকছে। সংশ্লিষ্ট মাঠ পর্যায়ের কর্মকর্তারা এবং বিশেষজ্ঞ বিজ্ঞানীরা পানিসম্পদ নিয়ে চরম উদ্বেগ প্রকাশ করেছেন। তারপরেও কোনরূপ ব্যবস্থা নেয়া হচ্ছে না। শুধু ফসল রক্ষা নয়, পরিবেশ ও জীব-বৈচিত্র ধ্বংসের পাশাপাশি নদ-নদীর দুইপাড়ের লাখ লাখ মৎস্যজীবী দিন দিন বেকার হয়ে পড়ছেন। মৎস্যজীবীদের বেঁচে থাকার অবলম্বন নদ-নদী ও খাল-বিলের পানি। পদ্মা থেকে বের হওয়া মাথাভাঙ্গা নদী এবং হার্ডিঞ্জ ব্রিজ পয়েন্টে পানি প্রবাহ নেই বললেই চলে। পানি উন্নয়ন বোর্ড ও হাইড্রোলজি বিভাগের দায়িত্বশীল সূত্র বলেছে, মরা নদে পরিণত হয়েছেÑ যশোর, খুলনা ও নওয়াপাড়ার ঐতিহ্যবাহী ভৈরব নদ। ভৈরব নদের কোথাও কোথাও অস্তিত্ব আর এখন খুঁজে পাওয়া যাবে না। সূত্রমতে, চুয়াডাঙ্গার মাথাভাঙ্গা, কুষ্টিয়ার গড়াই, শৈলকুপার কুমার নদী, ঝিনাইদদহের নবগঙ্গা, নড়াইলের চিত্রা ও মধুমতি, কালীগঞ্জের চিত্রা, যশোরের কপোতাক্ষ ও মুক্তেশ্বরীসহ গোটা অঞ্চলের ছোট-বড় নদ-নদীর পানিও দ্রুত কমে যাচ্ছে। ইতোমধ্যে এর কোন কোনটি খালে পরিণত হয়ে পড়েছে। এই অঞ্চলের নদ-নদীর পানির অবস্থা সম্পর্কে সরেজমিনে খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, মূলত পদ্মা ও পদ্মার শাখা-প্রশাখা, নদ-নদীতে পানি একেবারেই কমে গেছে। ভরা শুষ্ক মৌসুমে নদীর ওই পানিটুকুও না থাকার আশঙ্কা রয়েছে। বহুবছর ধরে এ অঞ্চলের সিংহভাগ নদ-নদী একযোগে সংস্কার হয়নি। এতে নদীগুলোর তলদেশ ভরাট হয়ে গেছে। বর্ষা মৌসুমের পানি ধারণ ক্ষমতাও হারিয়ে ফেলেছে নদীগুলো। তাছাড়া নদ-নদীর কোন কোন অংশে যতটুকু প্রবাহ আছে, তাও বন্ধ হয়ে যাচ্ছে অপরিকল্পিত ব্রিজ নির্মাণ, বাঁধ ও পাটাতন দিয়ে মাছ চাষ, অবৈধ দখল, সøুইস গেট ও পোল্ডার এবং বেড়িবাঁধ নির্মাণের কারণে। মানচিত্র থেকে অনেক নদীর নাম মুছে যাবার উপক্রম হয়েছে। পদ্মার মূল শাখা গড়াই দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের অধিকাংশ নদ-নদীর উৎপত্তিস্থল। পদ্মার সব শাখা নদী এখন মৃতপ্রায়। এই দৃশ্য দেখে নদপাড়ের মানুষের চোখে পানি আসছে। কয়েকজন জানালেন, এভাবে নদ-নদী শেষ হচ্ছে, অথচ আমরা চেয়ে চেয়ে দেখছি। ভারত পরিকল্পিতভাবে নদীগুলো শুকিয়ে মারছে, অথচ জোরালো কোন বাদ-প্রতিবাদ নেই। একসময় দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের নদ-নদীর যৌবন ছিল। বর্তমানে প্রায় সব নদ-নদীই মরা খালে পরিণত হয়ে অস্তিত্ব সংকটে।