
বৃহস্পতিবার দুপুরে ধানমন্ডির টিআইবি কার্যালয়ে প্রতিবেদনটি উপস্থাপন করেন প্রতিষ্ঠানটির রিচার্স অ্যান্ড পলিসির প্রোগ্রাম ম্যানেজার দিপু রায়।
নিয়োগ দুর্নীতির বিষয়ে টিআইবির প্রতিবেদনে বলা হয়, প্রতিষ্ঠানটি নিয়োগ ও পদোন্নতিতে ঘুষ লেনদেন, স্বজনপ্রীতি ও রাজনৈতিক বিবেচনাকে প্রধান্য দেওয়ার অভিযোগ রয়েছে। সংশ্লিষ্টতার অভিযোগ পাওয়া গেছে ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাদেরও।
প্রতিবেদনে বলা হয়, সিএজির দ্বিতীয়, তৃতীয় ও চতুর্থ শ্রেণির কর্মকর্তা-কর্মচারী নিয়োগে সংসদ সদস্যসহ বিভিন্ন রাজনৈতিক ব্যক্তিদের তদবির আসে। এমনকি এক পদের জন্য নয় মন্ত্রীর সুপারিশেওর প্রমাণ পাওয়া গেছে।
ঘুষের বিষয়ে প্রতিবেদন সূত্রে জানা গেছে, নিরীক্ষক, অধস্তন নিরীক্ষক ও গাড়িচালক নিয়োগের ক্ষেত্রে ৩ থেকে ৫ লাখ টাকা, স্থানীয় ও রাজস্ব অডিট ও বাণিজ্যিক অডিট কাজের জন্য ৫০ হাজার থেকে ৫ লাখ টাকা, পছন্দমত প্রতিষ্ঠান, প্রতিরক্ষা অডিট, স্থানীয় ও রাজস্ব অডিট, পূর্ত অডিট, বৈদেশিক সাহায্যপুষ্ট অডিটে কাজ করার জন্য ৫০ হাজার থেকে ২ লাখ টাকা ঘুষ নেওয়া হয়। এমনকি দীর্ঘ দিনের পুরোনো অডিট আপত্তি নিষ্পত্তিতেও নেয়া হয় ২০ হাজার টাকা ঘুষ।
প্রতিবেদনে প্রাপ্ত তথ্য বিশ্লেষণে আরো দেখা যায়, সিএজি কার্যালয়ের নিরীক্ষা দলের বিরুদ্ধে অডিট ইউনিটের কাছ থেকে কমপক্ষে ১০ হাজার থেকে ৫ লাখ টাকা পর্যন্ত ঘুষ আদায়ের অভিযোগ রয়েছে। তিন বছর পর বদলি করার নিয়ম থাকলেও ঘুষ ও রাজনৈতিক প্রভাবে একই কার্যালয়ে দীর্ঘদিন কর্মরত থাকা, অতিরিক্ত অর্থ আয়ের সুযোগ সম্পন্ন বিভিন্ন প্রতিষ্ঠা যেমন -বন্ডেড ওয়ার হাউজ, ডিফেন্স অডিটের পূর্ত সংক্রান্ত, এমপিওভুক্ত হওয়ার জন্য বিভিন্ন কলেজ ও স্কুল নিরীক্ষা করার জন্য ঘুষ আদায়ের অভিযোগ ইত্যাদি।
প্রতিবেদন অনুয়ায়ী দেখা যায়, সিএজি কার্যালয়ে দায়িত্ব পালনে স্বচ্ছতা ও জবাবদিহিতার ঘাটতি পরিলক্ষিত হয়। যেমন সিএজি কর্তৃক বার্ষিক পরিকল্পনা না করা- মহাপরিচালক পর্যায়ে জবাবদিহিতা না থাকা, উপ-পরিচালক পর্যায়ে মাঠ পর্যায়ে নিরীক্ষা আপত্তি যাচাই-বাছাই না করা, কখনও কখনও অন্যায়ভাবে আপত্তি নিষ্পত্তি করা, মাঠ পর্যায়ে নিরীক্ষার কাজ ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা কর্তৃক পরিবীক্ষণ না করা; মাঠ পর্যায়ের নিরীক্ষাকালীন দুর্নীতি ধরা পড়লেও শাস্তিমূলক ব্যবস্থা না নেওয়া; কর্তৃপক্ষের স্বাক্ষর ও তারিখ এবং গুরুত্বপূর্ণ দলিলাদি ঠিক নেই বলে অনেক সময় সংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠানকে নানাভাবে হয়রানি করা হয়।
সিএজি কার্যালয়ের অভ্যন্তরীণ ও বাহ্যিকভাবে বেশ কিছু চ্যালেঞ্জের বিষয়ে প্রতিবেদন সূত্রে জানা যায়, বাজেট, নিয়োগ, শিক্ষা সংক্রান্ত ছুটি, পদোন্নতি, নিয়মাবলী, আইনগত বিষয় ও সরকারি ক্রয়ের জন্য অর্থ মন্ত্রণালয় ও জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ের ওপর নির্ভরশীলতা থাকায় সাংবিধানিক সংস্থাটি স্বাধীনভাবে কার্যক্রম পরিচালনায় সক্ষম নয়। পূর্বের তুলনায় বাজেট, অডিট ইউনিট এবং সরকারের জনবলের সংখ্যা বৃদ্ধি পেলেও সিএজির প্রয়োজনীয় ও দক্ষ জনবল বৃদ্ধি না পাওয়া, ১৯৮৮ সালের অর্গানোগ্রামের জনবল দ্বারাই বর্তমান কার্যক্রম পরিচালনা করতে হচ্ছে।
অন্যদিকে দ্বিতীয় শ্রেণির অনুমোদিত পদের বিপরীতে শূন্য পদ রয়েছে ৫০০টি। মাত্র ২ হাজার ৫৬৬ জন কর্মকর্তা-কর্মচারী দ্বারা সরকারের প্রায় ৩০ হাজার সরকারি প্রতিষ্ঠানের নিরীক্ষা কার্যক্রম পরিচালনা করার ফলে অনেক ক্ষেত্রেই নিরীক্ষা প্রতিবেদন তৈরিতে দীর্ঘসূত্রতা সৃষ্টি হয় ও অনেক প্রতিবেদনে ভুল থাকে। এ ছাড়া জবাবদিহিতার সমস্যা ও তথ্য প্রকাশ প্রক্রিয়াও সচল নয়।
তবে প্রতিবেদনে সিএজির কিছু উল্লেখযোগ্য অগ্রগতির তথ্যও প্রকাশ করা হয়। যেখানে বলা, ২০১২ সাল থেকে নিরীক্ষা পদ্ধতিতে স্বয়ংক্রিয় প্রক্রিয়ার সংযোজন ছাড়াও মিডিয়া এবং কমিউনিকেশন সেল গঠন এবং তথ্য অধিকার আইনের যথাযথ ব্যবহারের পদক্ষেপ গ্রহণ, নিরীক্ষা প্রতিবেদন ও সিএজি কার্যালয়ের কার্যক্রম স¤পর্কে ওয়েবসাইটে তথ্য প্রকাশ এবং প্রথমবারের মতো প্রেস বিজ্ঞপ্তির মাধ্যমে নিরীক্ষা প্রতিবেদন জনসমক্ষে প্রকাশ করা হয়েছে।
জিএজি কার্যালয়ের সুশাসনের চ্যালেঞ্জসমূহ চিহ্নিত করে এবং তা থেকে উত্তরণের জন্য টিআইবি তিন পর্যায়ের ২০ দফা সুপারিশ উত্থাপন করে।
স্বল্পমেয়াদী সুপারিশের মধ্যে রয়েছে - আলোচনার ভিত্তিতে প্রস্তাবিত নিরীক্ষা আইন প্রণয়ন, অর্গানোগ্রাম ও নিয়োগের বিধিমালার অনুমোদন দেওয়া; সিএজিকে বাজেট, নিয়োগসহ সকল বিষয়ে সাংবিধানিক স্বাধীন ক্ষমতা প্রয়োগের অধিকার নিশ্চিতকরণ; সিএজিসহ সকল নিয়োগ রাজনৈতিক প্রভাবমুক্ত করা; সিএজিকে উচ্চ আদালতের বিচারপতির সম মর্যাদা দেওয়াসহ সকল পর্যায়ের কর্মকর্তা ও কর্মচারীদের মর্যাদা বৃদ্ধি করা; নিরীক্ষার প্রতিবেদন সম্পন্ন করার ও জমা দেওয়ার সুনির্দিষ্ট সময় সীমা নির্ধারণ করা; সিএজি কার্যালয়ের অভিযোগ সেল সম্পর্কে সরকারি কার্যালয়গুলোকে জানানোর জন্য ব্যাপক প্রচারণা চালানো এবং অভিযোগের ভিত্তিতে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেওয়া।
মধ্য মেয়াদী সুপারিশের মধ্যে রয়েছে - দুর্নীতির তথ্যগুলো সিএজি পিএসিকে দেবে এবং পিএসি অভিযোগ অনুযায়ী দৃষ্টান্তমূলক শাস্তির জন্য সুপারিশ করবে; ক্যাডার কর্মকর্তার সংখ্যা বৃদ্ধি করে কমপক্ষে ৩০% করা এবং মাঠ পর্যায়ে নিরীক্ষা করার জন্য নিরীক্ষা দল গঠন করা; জরুরি কার্যক্রমের (ক্রাস প্রোগ্রাম) মাধ্যমে দীর্ঘ দিনের পুরোনো নিরীক্ষা আপত্তিগুলো দ্রুত নিষ্পত্তির ব্যবস্থা করা এবং স্থানীয় ও রাজস্ব অডিট অধিদপ্তরকে দুটি আলাদা অধিদপ্তরে ভাগ করা ইত্যাদি।
আর দীর্ঘমেয়াদী সুপারিশের মধ্যে রয়েছে- সরকারি প্রতিষ্ঠানের অর্থ ব্যয় ও হিসাবের ক্ষেত্রে স্বচ্ছতা বৃদ্ধির জন্য মন্ত্রণালয়গুলোতে দক্ষ জনবলের সমন্বয়ে অভ্যন্তরীণ নিয়ন্ত্রণ শাখা খোলা; নিয়মানুবর্তী নিরীক্ষা থেকে পারফর্মেন্স নিরীক্ষার দিকে যাওয়ার কৌশল তৈরি করা এবং এজন্য প্রয়োজনীয় জনবল ও সক্ষমতা বৃদ্ধি।
অ্যাডভোকেট সুলতানা কামালের সভাপতিত্বে অনুষ্ঠানে উপস্থিত ছিলেন- টিআইবির নির্বাহী পরিচালক ড. ইফতেখারুজ্জামান, উপ-নির্বাহী পরিচালক অধ্যাপক ড. সুমাইয়া খায়ের এবং রিসার্চ অ্যান্ড পলিসি বিভাগের পরিচালক মোহাম্মদ রফিকুল হাসান।
0 coment rios: